ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন এরদোগান

আন্তর্জাতিক সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

সাঈদ চৌধুরী

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগান পুনরায় নির্বাচিত হয়েছেন। রোববার (২৮ মে ২০২৩) অনুষ্ঠিত রান-অফ তথা দ্বিতীয় দফার নির্বাচনে তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছেন। সরকারিভাবে ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে। সুপ্রিম ইলেকশন কাউন্সিলের প্রধান নির্বাচন কর্মকর্তা আহমেত ইয়েন জানান, রোববারের ভোটে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী কেমাল কিলিচদারোগলুর চেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছেন প্রেসিডেন্ট এরদোগান। তিনি ৫২ দশমিক ১৮ শতাংশ ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন।

তুরস্কে শত বছেরর সর্বাধিক জনপ্রিয় ও ক্যারিশম্যাটিক নেতা প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগান পশ্চিমা নেতিবাচক প্রচার ও পূর্বাভাস এবং ইসলাম বিরোধী ও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির সংঘবদ্ধ ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন।

জাতীয় কোনো নির্বাচনে কখনো পরাজিত হননি এরদোগান। বক্তৃতার মঞ্চে উঠে যেন নতুন জীবন পান। নির্বাচন সামনে রেখে প্রতিদিন শহরে শহরে ছুটেছেন তিনি। বিশাল সব জনসমাবেশে মোহনীয় বক্তৃতা দিয়েছেন। দেশের মানুষের মধ্যে সামাজিক পরিবর্তন ও মূল্যবোধ জাগ্রত করেছেন।

সমাজে পিছিয়ে পড়া মানুষের সাহায্যে হাত বাড়িয়ে দেওয়া এবাদত মনে করেন এরদোগান। সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়বদ্ধতা এক মূহুর্তের জন্য ভুলেননি। তুরস্কের মানুষও তার প্রতি আস্থা রেখেছেন। দেশ গড়ার সংগ্রামে দৃঢ় প্রত্যয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন। তার সততা, নিষ্ঠা ও মানুষের কল্যাণে নিরন্তর কাজ করে যাওয়ার প্রাণান্ত প্রয়াস জনগণের হৃদয়কে গভীরভাবে আলোড়িত করেছে। নির্বাচনের ফলাফলে তা-ই প্রমানিত হয়েছে।

রোববার সকাল ৮টায় ভোটগ্রহণ শুরু হয়ে তা শেষ হয়েছে বিকেল ৫টায়। এবারে দেশটিতে ভোটার ছিলেন ৬ কোটি ৪২ লাখ মানুষ। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত প্রাথমিকভাবে ব্যালট গণনা সম্পন্ন হয়েছে। এতে রজব তাইয়েব এরদোগান পেয়েছেন ৫২ দশমিক ১৮ শতাংশ (২,৭৮,৩৪,৬৯২ ভোট) এবং প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী কেমাল কিলিচদারোগলু পেয়েছেন ৪৭ দশমিক ৮২ শতাংশ (২,৫৫,০৪,৫৫২ ভোট)। নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন ৮৪ দশমিক ১৫ ভাগ ভোটার।

এরদোগানের জয় নিশ্চিত হওয়ার সাথে সাথে ক্ষমতাসীন একে পার্টির কর্মী-সমর্থকরা তুরস্কজুড়ে আনন্দ মিছিল শুরু করেছেন। সমর্থকরা তার ইস্তাম্বুলের বাসভবনে জড়ো হয়ে ‘আল্লাহু আকবর’স্লোগান দিচ্ছেন।

প্রায় সাড়ে ৮ কোটি মানুষের এই দেশটির নির্বাচনে পুনরায় জয় লাভ এরদোগানের অপরাজেয় ভাবমূর্তি আরও দৃঢ় ও সংহত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

১৪ মে তুরস্কে প্রথম দফার ভোট হয়। এরদোগান ৪৯ দশমিক ৫২ শতাংশ (২,৭১,৩৩,৮৩৭ ভোট) এবং তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী কেমাল ৪৪ দশমিক ৮৮ শতাংশ (২,৪৫,৯৪,৯৩২ ভোট) পেয়েছিলেন। এরদোগান তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে প্রায় ৫ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ২৬ লাখ ভোট বেশি পেয়েছেন।

এরদোগানের জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির নেতৃত্বাধীন পিপলস অ্যালায়েন্স ৬০০ আসনের পার্লামেন্টে ৩২১টি আসন পেয়েছে। এর মধ্যে জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি ২৬৬টি, ন্যাশনালিস্ট মুভমেন্ট পার্টি ৫০টি এবং নিউ ওয়েলফেয়ার পার্টি ৫টি আসন লাভ করেছে। বিরোধী জোট পার্লামেন্টে ২১৩টি আসন পেয়েছে। কিলিচদারোগ্লুর রিপাবলিকান পিপলস পার্টি ১৬৯টি ও গুড পার্টি ৪৪টি আসন পেয়েছে।

তুরস্কে ভোটের নিয়ম অনুযায়ী কোনো প্রার্থী ৫০ শতাংশ ভোট পাননি। তাই নির্বাচন দ্বিতীয় দফায় গড়ায়। দ্বিতীয় দফার ভোটে মুখোমুখি হন বর্তমান প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগান ও বিরোধী নেতা কেমাল কিলিচদারোগ্লু।

প্রথম দফার ভোটে তৃতীয় হন জাতীয়তাবাদী রাজনীতিক সিনান ওগান। তিনি পেয়েছিলেন ৫ দশমিক ১৭ শতাংশ ভোট। দ্বিতীয় দফার ভোটে তিনি এরদোগানকে সমর্থন দেন।

তুরস্কের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত রান-অফ নির্বাচনে জয়ী হয়ে এরদোগান নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। হয়ে ওঠেছেন তুরস্কের সবচেয়ে বেশি সময়ের শাসক। ৯ বছর প্রেসিডেন্ট আর ১১ বছর প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করা এরদোগানের নেতৃত্বের প্রতি জনতার সুদৃঢ় সমর্থন দিন দিন বেড়েই চলেছে।

এরদোগান ১৯৯৪ সালে প্রথম ইস্তাম্বুলের মেয়র নির্বাচিত হন। এরপর ২০০২, ২০০৭ ও ২০১১ সালের জাতীয় নির্বাচনেও জয় হয় এরদোগানের। ২০০৩ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ছিলেন তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী। এরপর দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালের ভোটেও তার ওপরই আস্থা রাখেন তুরস্কের জনগণ।

এবার ২০২৩ সালে এসে নিজের সেই জয়ের ধারা অব্যাহত রেখেছেন এরদোগান। টানা তৃতীয় মেয়াদে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন। আগামী পাঁচ বছরও মুসলিম বিশ্বে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান নিয়ে চলা দেশটির নেতৃত্ব দেবেন তিনি।

টানা তৃতীয় মেয়াদে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর সমর্থকদের উদ্দেশে বক্তব্য দেন রজব তাইয়েব এরদোগান। নিজের শহর ইস্তাম্বুলে এক ভাষণে তিনি বলেন, আমরা আগামি পাঁচ বছর দেশ পরিচালনা করব। সৃষ্টিকর্তা চাইলে আপনাদের আস্থার প্রতিদান দেব।

‘নতুন যুগ’এর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ২০ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা বতর্মান প্রেসিডেন্ট। তিনি বলছেন, আমরা মানুষের ব্যাপক ভালোবাসায় নতুন শক্তি ও অনুপ্রেরণা লাভ করছি। গত নির্বাচনে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ন্যায়বিচার ও নিরাপত্তার প্রভূত উন্নতি হবে। সেই প্রতিশ্রুতি পূর্ণরূপে রক্ষা করেছি।

এরদোগান আরো বলেন, ২০০২ সালে একে পার্টি ক্ষমতায় এসে কেবল এই চার দিকের উন্নয়নেই ক্ষ্যান্ত থাকেনি। পাশাপাশি পরিবহন, কৃষি ও কূটনীতির ক্ষেত্রেও দেশকে অগ্রসর করেছে। উন্নত হয়েছে দেশের তথ্য প্রযুক্তি ও অবকাঠামোর।

জয়ের পর এক টুইটার বার্তায় এরদোগান বলেন, জনগণের ইচ্ছাকে সর্বোচ্চ সম্মান করি। তাদের ইচ্ছাকে সুরক্ষা করার সময় এসেছে এখন।

তিন মাস আগে দেশটিতে আঘাত হানা স্মরণকালের ভয়াবহ ভূমিকম্পে অর্ধ-লাখের বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। ভূমিকম্পের পর উদ্ধার ও ত্রাণ তৎপরতায় তিনি সর্বাত্বক ভূমিকা পালন করেছেন। এখন ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পুনর্বাসনে অগ্রাধিকার হিসেবে বিশেষ কর্মসূচি গ্রহনের ঘোষণা করেন এরদোগান।

রাজনীতিতে এরদোগানের উঠে আসা গত শতকের সত্তরের দশকে ইস্তাম্বুলের বেইওগ্লু অঞ্চল থেকে। তাঁর শৈশব কেটেছে শ্রমজীবী মানুষ অধ্যুষিত ওই অঞ্চলের কাসিমপাসা এলাকায়।

১৯৭৬ সালে এরদোয়ান প্রথম ন্যাশনাল স্যালভেশন পার্টির যুব শাখার বেইওগ্লু অঞ্চলের প্রধান নির্বাচিত হন। ন্যাশনাল স্যালভেশন পার্টির প্রধান ছিলেন নাজিমুদ্দিন এরবাকান। তিনি পরে ১৯৯৬–৯৭ মেয়াদে তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। নাজিমুদ্দিন এরবাকানকে এরদোয়ানের রাজনৈতিক গুরু হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।

একে পার্টির শাসনের প্রথম দশকে তুরস্কে গণতান্ত্রিক সংস্কার ঘটে। তা করা হয়েছিল দেশটির ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দেওয়া আকাঙ্ক্ষা থেকে। এ সময় দেশে সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব কমতে থাকা এবং নারী ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষায় কাজ করার জন্য দেশ–বিদেশে উদারপন্থীদের প্রশংসা পান এরদোগান।

ইস্তাম্বুল থেকে এএফপি‘র প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, তুরস্কে সেতু, মহাসড়ক, বিমানবন্দর, মসজিদ—কী নির্মাণ করেননি এরদোগান! শুরুতেই বলা যায় তিনটি সেতুর কথা। তার ভাষায়, এগুলো ‘মাথা খারাপ করে দেওয়ার মতো প্রকল্প’। এ প্রকল্পে বসফরাস প্রণালির ওপর একটি, মারমারা সাগরের ওপর একটি ও দারদানেলেস প্রণালির ওপর একটি সেতু রয়েছে।

তিনটি সেতুই রেকর্ড করেছে। যেমন করেছে ইস্তাম্বুলের কামলিকা মসজিদ। ছয় মিনারের এই মসজিদ তুরস্কের সবচেয়ে বড় মসজিদ। একসঙ্গে ৩০ হাজার মুসল্লির নামাজ পড়ার সুযোগ রয়েছে সেখানে। তবে এসবের মধ্যে সবচেয়ে তাক লাগানোর মতো ইস্তাম্বুল খাল। বর্তমানে বসফরাস প্রণালির পশ্চিমে এই খালের নির্মাণকাজ চলছে।

এখানেই শেষ নয়। রয়েছে উচ্চগতির ট্রেন, ইস্তাম্বুলের তৃতীয় বিমানবন্দর ও নানা বিদ্যুৎকেন্দ্র। বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর একটি পারমাণবিক। আর নির্মাণের পর ইস্তাম্বুলের তৃতীয় বিমানবন্দরটি হবে বিশ্বের সবচেয়ে বড়।

ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে তুরস্কের কৌশলগত অবস্থানে ভারসাম্য ধরে রেখেছেন এরদোয়ান। কূটনৈতিক সুবিধা উপভোগের জন্য কৃষ্ণসাগরের দক্ষিণ উপকূল ও ভূমধ্যসাগরের উত্তর উপকূল ভালোভাবেই সামলে রেখেছেন তিনি।

ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা শুরুর পরপরই এরদোয়ান যুদ্ধ বন্ধে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় নেমেছিলেন। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে হাতে গোনা যে কয়েকজন বিশ্বনেতার ঘনিষ্ঠতা রয়েছে, তাঁদের মধ্যে একজন তিনি। আবার রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়তে ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তাও দিয়েছেন। ইউক্রেনের শস্য রপ্তানি চুক্তি তৈরিতে তাঁর ভূমিকা বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছে।

‘গ্যালাপ ইন্টারন্যাশনাল’ কর্তৃক বৈশ্বিক রাজনৈতিক নেতাদের জনপ্রিয়তা সূচকে এরদোগান শীর্ষদের মধ্যে রয়েছেন। তিনি হলেন বিশ্বের পঞ্চম জনপ্রিয় নেতা। আর মুসলি বিশ্বে সবার শীর্ষে এখন এরদোগান। নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে মুসলিম দুনিয়ার সর্বত্র এরদোগানকে সমর্থন ও সফলতার জন্য মোনাজাত এক নজির বিহীন মাত্রা লাভ করেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *