ইউক্রেন যুদ্ধ: খাদ্যসংকট ফিলিস্তিনে

অর্থনীতি আন্তর্জাতিক সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

এম এ আলআমিন

ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে গম ও অন্যান্য প্রধান খাদ্যশস্যের মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ায় বিভিন্ন দেশে খাদ্যসংকটের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। রুশ আগ্রাসনের ফলে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্হা ভেঙে পড়তে বসেছে। বিভিন্ন দাতা সংস্হার সূত্রে এ খবার পাওয়া গেছে।

ফিলিস্তিনি নিয়ন্ত্রিত ভূখণ্ড পশ্চিম তীর ও গাজায় যে গম আমদানি করা হয় তার প্রায় ৯০ শতাংশ আসতো ইউক্রেন থেকে। ভূখণ্ডগুলো ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের অধীনে থাকলেও সেগুলো ইসরায়েল অধিকৃত। ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরুর আগে থেকেই ফিলিস্তিনিদের খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সংকট ছিল। যুদ্ধ শুরুর পর পরিস্হিতি আরো জটিল হয়েছে।

জাতিসংঘে নিযুক্ত মার্কিন উপরাষ্ট্রদূত রিচার্ড মিলস সম্প্রতি নিরাপত্তা পরিষদে বলেছেন, ‘গাজায় মানবিক সহায়তা, পুনর্গঠন কাজ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর তীব্র ঘাটতি রয়েছে।’ তিনি এমন পরিস্হিতি সৃষ্টির জন্য রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিনা উসকানিতে ইউক্রেন আক্রমণকে দায়ী করেন।

আটার দাম এক বছর আগের তুলনায় পশ্চিম তীরে ১৮ শতাংশ ও গাজায় ২৪ শাতংশ বেড়েছে। আগে থেকেই আর্থিক সংকটে থাকা ফিলিস্তিনিদের জন্য এটা বাড়াতি চাপ সৃষ্টি করেছে। শুধু আটার দাম বেড়েছে তাই নয়, ডাল, নুন, ভোজ্য তেল, জ্বালানি তেল এমন কি পশুখাদ্যেরও দাম হঠাত্ করেই অনেক বেড়েছে। পশুখাদ্যের দাম ৬০ শতাংশের বেশি বেড়েছে যা সার্বিকভাবে তাদের পশু সম্পদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

ফিলিস্তিনি ইসলামপম্হি গ্রুপ হামাস গাজা উপত্যাকা নিয়ন্ত্রণ করায় ইসরায়েল ভূখণ্ডটির ওপর নানারকম বাধা-নিষেধ দিয়ে রেখেছে। ফলে সেখানে আরেকটি মানবিক বিপর্যয় আসন্ন বলে অনুমান করা যায়। ২০০৭ সাল থেকে হামাস উপত্যকাটি নিয়ন্ত্রণ করেছে। এরই মধ্যে সেখানে কয়েকবার যুদ্ধ হয়েছে। অবরোধের জন্য যুদ্ধগুলোর ক্ষত পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি ফিলিস্তিনিরা।

অক্সফামের আরেকজন কর্মকর্তা নোয়া গটসশ্লক বলেন, ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মিলে গাজাকে বহির্বিশ্ব থেকে যেভাবে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে সেটি স্হানীয় বাসিন্দাদের মনস্তত্বের ওপর গভীরভাবে ছাপ ফেলেছে। তবে ইসরায়েলের একজন কর্মকর্তা এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।তিনি দাবি করেন, গাজা থেকে প্রতিদিন বহু ফিলিস্তিনি বাইরে গিয়ে কাজ করতে পারছে। ইসরায়েল থেকে প্রতিদিন খাদ্যবাহী শত শত ট্রাক গাজায় যাচ্ছে। খাদ্য পণ্যের ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা নাই। সেখানে ইসরায়েল ১৫ বছর ধরে অবরোধ দিয়ে রেখেছে। খাদ্যপণ্যও অনেক সময় নিষেধাজ্ঞার তালিকায় থাকে, অতীতে অনেক সময় এটা দেখা গেছে। গাজার বাসিন্দাদের ৮০ ভাগই বাইরের মানবিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল। সেখানে সুপেয় পানিরও ঘাটতি আছে।

ইউনিসেফের বিশেষ প্রতিনিধি লুসিয়া ইলমি বলেন, পুরো ফিলিস্তিনি নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোতে প্রায় ১০ লাখ শিশুর জরুরি মানবিক সহায়তা প্রয়োজন। যে কোনো মানবিক সংকটে শিশুরাই এর প্রধান শিকার হয়ে থাকে।

ইউক্রেন যুদ্ধ বৈশ্বিক খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্হার ওপর কতটা প্রভাব ফেলেছে এই ঘটনা তার একটি খণ্ডচিত্র মাত্র। রাশিয়া ও ইউক্রেন বহু দেশের প্রধান খাদ্যশস্য সরবরাহকারী দেশ। দেশগুলো বেশির ভাগই দরিদ্র বা উন্নয়নশীল ক্যাটাগরিতে পড়ে। যুদ্ধ শুরুর পর দেশগুলোর খাদ্যশিল্প অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের আরেকটি দেশ লেবাননের ৮০ ভাগ গম আমদানি করা হয় ইউক্রেন থেকে। দীর্ঘদিনের আর্থিক সংকট কাটিয়ে লেবানন যখন কিছুটা স্বাভাবিক অবস্হায় ফেরে তখনই ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু হয়।

আফ্রিকান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের তথ্য মতে, মহাদেশটিতে গমের দাম গড়পড়তা ৬২ শতাংশ বেড়েছে। জিম্বাবুয়েতে রুটির দাম এখন ১০০ শতাংশ বেড়ে গেছে। দাতব্য সংস্হা অক্সফামের সিনিয়র পলিসি অ্যাডভাইজার আইরিন ক্রুইজিংগা বলেন, ‘খাদ্য নিরাপত্তার ভবিষ্যত্ অন্ধকার বলেই মনে হয়।’ ‘ইউক্রেন যুদ্ধ বৈশ্বিক ইসু্যকে যতটা নাড়া দিতে পেরেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আর কোনো ঘটনায় সেরকমটি আমরা দেখি না’ বলেছেন ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রামের নির্বাহী পরিচালক ডেভিড বিসলে। মার্চে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের এক বৈঠকে তিনি ঐ মন্তব্য করেন।

তিনি বলেন, ‘আপনার যুদ্ধক্ষেত্রের ধ্বংসযজ্ঞই কেবল দেখছেন কিন্তু এর বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এই যুদ্ধ যে ক্ষত তৈরি করছে সেটি আমাদের দৃষ্টির আড়ালেই থেকে যাচ্ছে।’

ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে কর্মরত ত্রাণ সংস্হাগুলো জানিয়েছে, তারা সেখানে মানবিক সহায়তা পৌঁছাতে আপ্র্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এই সংস্হাগুলোর সামনে এখন দুটো চ্যালেঞ্জ। একটি হলো অর্থায়ন। অপরটি যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ হিসাবে ইউক্রেনের দিকে এখন তাদের দৃষ্টি দিতে হবে। ফলে বেড়েই চলেছে ভাগ্য বিড়ম্বিত ফিলিস্তিনিদের দুর্ভোগের কাহিনী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *