আল মাহমুদের সোনালি কাবিন ।। ড. ফজলুল হক তুহিন

শিল্প-সংস্কৃতি সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

(পূর্ব প্রকাশের পর)

তিন

আল মাহমুদ : কবি হয়ে ওঠা

একটি ঐতিহ্যবাহী, সম্ভ্রান্ত ও সচ্ছল পরিবারে কবি আল মাহমুদের জন্ম হলেও কৈশোরেই পিতার ‘ব্যবসায় ক্রমাগত অসাফল্য ও ব্যর্থতা’ তাদের পরিবারকে দারিদ্র্যে নিমজ্জিত করে। তাদের কাপড়ের দোকান বন্ধ হলে এবং ফায়ার সার্ভিসে চাকরি নিয়ে পিতা চলে গেলে কবি অবাধ স্বাধীনতা পেয়ে যান। ফলে প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ায় আর কখনোই মনোযোগী হতে পারেননি। বাউণ্ডুলেপনা, কবিতাচর্চা, সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, ব্যাপকভাবে অপ্রাতিষ্ঠানিক অধ্যয়ন তাকে প্রচলিত পথে অগ্রসর হতে দেয়নি। তবে জীবন বাস্তবতার জন্যে ১৯৫৪ সালে তিনি ঢাকায় আসেন স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্যে, জীবন-জীবিকার প্রয়োজনেই; তবে কবি হওয়ার স্বপ্ন ছিলো তাঁর চোখে ও মনে।

“পঞ্চাশ দশকের গোড়ার দিকে আমি একটা টিনের সুটকেস নিয়ে ফুলবাড়িয়া স্টেশনে এসে নামলাম। সম্ভবত সেটা ছিল শীতকাল। সন্দেহ নেই আমি কবি হওয়ার প্রতিজ্ঞা নিয়ে এ প্রাচীন মোগলাই শহরে পা রেখেছিলাম।”১৫

একদিকে কবি হবার ‘প্রতিজ্ঞা’; অন্যদিকে জীবনধারণের প্রয়োজনেই কবি ঢাকা এসে ওঠেন এক সময়ে দাদার বাড়ির গৃহশিক্ষক ও স্বল্পখ্যাত লেখক লুৎফর রহমানের কাছে, নবাবপুরের দিনমজুরের হোটেলে। সেখানে থেকে লুৎফর রহমানের মাধ্যমে ‘দৈনিক মিল্লাতে’ প্রুফ রিডার হিসেবে কাজে যোগদান করেন। নজমুল হক সম্পাদিত ‘সাপ্তাহিক কাফেলা’য় (১৯৫৫) লেখালেখির সূত্রে যাতায়াত শুরু করেন এবং এক সময় সহযোগী সম্পাদক কবি আবদুর রশীদ ওয়াসেক পুরী এই পত্রিকা ছেড়ে চলে গেলে আল মাহমুদ সম্পাদনার দায়িত্ব (১৯৫৫-৫৬) পান। ১৯৫৭-তে বিয়ে করার পর ‘কাফেলা’ ও ‘মিল্লাতে’র সাংবাদিকতা ছেড়ে দিয়ে বাড়ি চলে যান। ঘুঙ্গুর-শালদা নদী স্কীমের অধীনে নবীনগর থেকে সিদ্ধেশ্বরী পর্যন্ত খাল খননরত ড্রেজার বালেশ্বরে ‘গেজ রিডার’ হিসেবে কাজ করেছেন বৎসরাধিক। জীবিকার প্রয়োজনে এ সময় তিনি লাইফবয় সাবান সাইকেলে করে ফেরিও করেন। আবার পিতার নির্দেশে ঢাকায় প্রত্যাবর্তন (১৯৬৩) এবং ‘দৈনিক ইত্তেফাকে’ প্রুফরিডার হিসেবে যোগদান করেন। এ সময় তাঁর আর্থিক সচ্ছলতা কিছুটা ফিরে আসে। ৬৯-এর উত্তাল গণঅভ্যুত্থানের ফলে সরকার আবার ইত্তেফাক বন্ধ করে দেয়। কবি আবারো অনিশ্চয়তার মাঝে পড়ে যান; কিন্তু বাংলা একাডেমীর পুরস্কার (১৯৬৮) তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দয়। প্রাপ্ত অর্থ সেই দুঃসময়ে অত্যন্ত সাহায্য করেছে তাকে। কবি সেই সময়ের অনুভূতি ব্যক্ত করেন এভাবে:

“দাদা ভাই শিশু সাহিত্যে, আমি কাব্যে। আরো দু’জন ছিলেন। তারা কিসে পেয়েছেন আজ আর মনে নেই। টাকার অংকটা ছিল ৫ হাজার টাকা, আমার জন্য অনেক। অনেক, অনেক, অনেক। সবচেয়ে বড় কথা হলো, ততদিনে আমার জন্য আমার প্রথম পুত্র প্রসব করেছে আমার স্ত্রী। লজ্জায়, ভয়ে, দারিদ্র্যে আমি শ্বশুরবাড়ি যাইনি। যা হোক, ‘বাংলা একাডেমী’র পুরস্কার আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে।”১৭

‘ইত্তেফাক’ বন্ধের কারণে কবি চট্টগ্রামে চলে যান এবং চট্টগ্রামের আর্ট প্রেসে খ্যাতিমান কবি ও প্রাবন্ধিক সৈয়দ আলী আহসানের (১৯২২-২০০২) সাহায্যে কাজে যোগদান করেন। আবার এখলাস উদ্দীনের আগ্রহে প্রকাশনা সংস্থা ‘বইঘর’-এর প্রকাশনা কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেন এবং এই প্রতিষ্ঠানের সৈয়দ মোহাম্মদ শফি চট্টগ্রামের পাথর ঘাটা এলাকায় ইকবাল ম্যানসনে থাকার ব্যবস্থা করেন। এখানে থাকাবস্থায় কবিকে সহযোগিতা করেন বিখ্যাত বংশীবাদক সুচরিত চৌধুরী।

‘ইত্তেফাক’ পুনরায় চালু হলে কবি আবার যোগদান করেন সহসম্পাদক রূপে। এ সময় কবিজীবনে সচ্ছলতা ফিরে আসে। কিন্তু স্বাধীনতার জন্যে উত্তাল ও বিক্ষুব্ধ হতে থাকে দেশ। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী ঢাকায় ঝাপিয়ে পড়ার সাথে সাথে ‘ইত্তেফাক’ অফিসও গুড়িয়ে দেয়। কবি সীমান্ত পার হয়ে ভারতের পশ্চিম বঙ্গে আশ্রয় নেন এবং কলকাতার ৮ নং থিয়েটার রোডে মুজিব নগর সরকারের প্রতিরক্ষা বিভাগের স্টাফ অফিসার হিসেবে কাজ করেন। এসময় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উদ্যোগে প্রকাশিত ‘লোক লোকান্তর’ ও ‘কালের কলস’ এবং অপ্রকাশিত ‘সোনালি কাবিনে’র পাণ্ডুলিপিসহ ‘আল মাহমুদের কবিতা’ (১৯৭১) শিরোনামে ‘অরুণা প্রকাশনী’ থেকে একটি সংকলন প্রকাশ হয়। এর ফলে রয়ালিটি (Royality) হিসেবে কবি নয় শত টাকা পান; এতে তার অভাবনীয় উপকার হয়।

মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলে দেশে ফিরে কবি ‘গণকণ্ঠে’র (১৯৭২) সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পান; এরপর ১৯৭৪ সালে গ্রেফতার হন এবং ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে এক বছর জেল খাটেন। এ সময় তাঁর ও তাঁর পরিবারের অবর্ণনীয় কষ্ট-দুর্ভোগ সহ্য করতে হয়েছে। ১৯৭৫ সালে জেল থেকে বের হয়ে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ‘শিল্পকলা একাডেমী’তে প্রকাশনা বিভাগের সহকারী পরিচালক পদে যোগদান করে ১৯৯৩ সালে অবসরে যান। এ সময় তিনি আর্থিকভাবে বেশ সচ্ছলতা অর্জন করেন। অতঃপর তিনি ‘দৈনিক সংগ্রামে’র সহকারী সম্পাদক (১৯৯৩) ও চট্টগ্রামের ‘দৈনিক কর্ণফুলী’র সম্পাদক (১৯৯৬-২০০৪) হিসেবে যোগদান করেন। জীবনের পড়ন্ত বেলায় এসে কাব্যখ্যাতির সঙ্গে সঙ্গে কবি আর্থিকভাবেও সচ্ছল হয়েছেন।

আল মাহমুদ কৈশোরেই অগ্রজ কবিদের কাব্যপাঠে মনোযোগী হন। বিশেষভাবে নজরুলের ‘অগ্নিবীণা’ ও জীবনানন্দ দাশের ‘মহাপৃথিবী’র কবিতাবলী তাকে প্রবলভাবে অনুপ্রাণিত করে। তাদের কবিতা পড়তে পড়তে মনে হয়েছে: ‘এ ধরনের বক্তব্য আমারও আছে আমিও লিখতে পারি।’ এই ভাবনা থেকেই প্রথম কবিতার জন্ম। ক্রমাগত কবি কবিতার খাতা ভরিয়ে ফেলতে থাকেন তীব্র উত্তেজনা ও উদ্দীপনায়। তবে এ সময় তিনি গল্প লেখায়ও হাত দেন; ফলশ্রুতিতে সপ্তম শ্রেণীতে পড়াকালীন কলকাতার ‘সত্যযুগ’ পত্রিকায় তাঁর ‘তিতাস চরের ছেলে’ প্রথম কিশোর গল্প প্রকাশ পায়। ‘সাধনা হাইস্কুলে’ পড়াবস্থায় খায়রুল আনাম খাঁ সম্পাদিত কলকাতার সাপ্তাহিক ‘মোহাম্মদী’ পত্রিকার ছোটদের পাতার সঙ্গে পরিচয়। এ সময় এই পত্রিকাটিই ছিলো তাঁর ‘একমাত্র পাঠ্য বিষয়’। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন কমিটির লিফলেটে চার লাইনের একটি কবিতা ছাপার অপরাধে পুলিশের তাড়া খেয়ে কবি কলকাতাসহ বিভিন্ন জায়গায় পালিয়ে বেড়ান এবং কবিতা চর্চা করে সময় কাটান। ১৯৫৪ সালে কবি হবার বাসনা ও স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্যে ঢাকায় লুৎফর রহমানের কাছে এসে ওঠেন। শুরু হয় এক নতুন ও কঠিন কবিজীবন।

“ইতিহাসের গতির দিকে স্তব্ধ দৃষ্টি। ঠিক এ সময়কালেই এক অবিশ্বাস্য বাসনা নিয়ে আমি ঢাকায় প্রবেশ করি। আমি হবো এক কবি। জীবনের গূঢ় রহস্যের যে অভিজ্ঞতা আমি সঞ্চয় করবো তা ছন্দময় ভাষায় বর্ণনা করবো আমি।”২০

এই বাসনা পূরণে ‘দৈনিক মিল্লাতে’ প্রুফরিডার হিসেবে কাজে যোগদান এবং লেখা ছাপার সূত্রে সাপ্তাহিক ‘কাফেলা’র সম্পাদক নজমুল হক এবং সহযোগী সম্পাদক কবি আবদুর রশীদ ওয়াসেকপুরীর সঙ্গে পরিচয় ঘটে। পরবর্তী সময়ে ‘কাফেলা’য় নিয়মিত যাতায়াত, লেখালেখি, তরুণ লেখকদের সঙ্গে পরিচয় এবং লেখা চাপার নির্বিঘ্ন পরিবেশ কবি পেয়ে যান।

অন্যদিকে এই সময়ের মধ্যেই তাঁর কবিতা কলকাতার অনীলচন্দ্র সিংহ সম্পাদিত ‘নতুন সাহিত্য (১৯৪৯); সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় (১৯৩৪-২০১২) সম্পাদিত ‘কৃত্তিবাস’ (১৯৫৪); জগদিন্দ্র মণ্ডল সম্পাদিত ‘ময়ূখ’ (১৯৫৩); হুমায়ুন কবির (১৯০৬-৬৯) সম্পাদিত ‘চতুরঙ্গ’ (১৯৩৯); সাগরময় ঘোষ (১৯১২-৯৯) সম্পাদিত ‘দেশ’ ইত্যাদি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ‘খেলাঘর’-এ যাতায়াতের সূত্রে কবি ওমর আলীর (১৯৩৯-২০১৫) সঙ্গে তাঁর পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। ওমর আলীর কাছ থেকে কবি জানতে পারেন ঢাকার প্রগতিশীল লেখক ও সংগঠনের তৎপরতা। নাসির উদ্দীন (১৮৮৮-১৯৯৪) সম্পাদিত ‘সওগাত’ পত্রিকার অফিসে ‘পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ’-এর সাহিত্য আসরের আয়োজন হতো। সেখানে গিয়ে কবি পরিচিত হন হাসান হাফিজুর রহমান (১৯৩২-১৯৮৩), বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর (জ.১৯৩৬), আনিসুজ্জামান (১৯৩৭-২০২০), আলাউদ্দীন আল আজাদ (১৯৩২-২০০৯), খালেদ চৌধুরী (১৯১৯-২০১৪), শামসুর রাহমান (১৯২৯-২০০৬), ফজল শাহাবুদ্দীন (১৯৩৬-২০১৪), শহীদ কাদরী (১৯৪২-২০১৬), সায়ীদ আতিকুল্লাহ (১৯৩৩-৯৮) প্রমুখ লেখকদের সঙ্গে।

কবি মার্কসবাদী সাহিত্য তত্ত্বে ‘বশীভূত’ হয়ে ঢাকায় এলেও কঠোর সমালোচনা রীতির কারণে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যে বিশ্বাসী ‘রোমান্টিক গ্রুপে’র কবিদের সঙ্গে। বাংলাবাজারের ‘বিউটি বোর্ডিং’-কেন্দ্রিক সাহিত্য আড্ডার সদস্য শামসুর রাহমান, ফজল শাহাবুদ্দিন, শহীদ কাদরী, সেবাব্রত চৌধুরী প্রমুখ কবির সঙ্গে তাঁর অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এ সময় ঘটনাক্রমে ‘কাফেলা’র সম্পাদনার ভার আসলে কবি সেই সময়ের কবিদের কবিতা প্রকাশের মাধ্যমে সহায়তা করেন। এদিকে সে সময়ের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ কবিতার কাগজ বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকায় সাহস করে তিনটি কবিতা পাঠানোর পর মনোনীত হবার চিঠি পেয়ে কবি অভিভূত এবং উদ্দীপ্ত হয়ে যান।

“আমি আনন্দটা চেপে রাখলাম। কেউ জানলো না বাংলাদেশের এক অখ্যাত তরুণতম কবির কবিতা বুদ্ধদেব তার ঐতিহাসিক কাব্যান্দোলনের মুখপাত্র কবিতা পত্রিকার জন্য মনোনয়নের ইঙ্গিত দিয়েছেন। অকস্মাৎ আমার চাল চলনই বদলে গেল।”২২

পরবর্তী চৈত্র্য সংখ্যায় (১৯৫৬) তিরিশ ও চল্লিশের কবিদের সঙ্গে পঞ্চাশের কবিদের কবিতা প্রকাশিত হয়। ‘কবিতা’ পত্রিকা কর্তৃক এই স্বীকৃতিতে পঞ্চাশের কবিদের মধ্যে তাঁর আত্মবিশ্বাস ও আত্মতৃপ্তি কাজ করে। এ সংখ্যায় আল মাহমুদের তিনটি কবিতা প্রকাশ পেলে নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কার করেন।

বায়ান্নোত্তর কবিদের সঙ্গে কলকাতা ফেরত চল্লিশ দশকের প্রতিষ্ঠিত কবিদের এক ধরনের দূরত্ব তৈরি হয়ে যায়; মূলত পঞ্চাশের কবিদের কলকাতাকেন্দ্রিক কাব্যপ্রীতি এবং পাকিস্তানের আদর্শে আস্থাহীনতার কারণে। তবে আল মাহমুদ ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণে ফররুখ আহমদ (১৯১৮-৭৪), আহসান হাবীব (১৯১৭-৮৫), সৈয়দ আলী আহসান (১৯২২-২০০২), তালিম হোসেনের (১৯১৮-১৯৯৯) মতো কবিদের ‘দুর্লভ নৈকট্য’ পান।

‘দৈনিক ইত্তেফাকে’ চাকরি (১৯৬৩) আল মাহমুদের কাব্যজীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আর্থিক সচ্ছলতা ও অনুকূল আবহ দুটোই তিনি এখান থেকে পেয়ে যান। এই দৈনিকে যোগদানের কিছুদিন পরেই সাংবাদিক, লেখক, শিল্পীরা মিলে ‘কপোতাক্ষ’ নামে একটি যৌথ প্রকাশনা সংস্থা গড়ে তোলেন একশ টাকা চাঁদা তুলে। উদ্যোক্তাদের মধ্যে ছিলেন কবি রফিক আজাদ (১৯৪১-২০১৬) ও আসাদ চৌধুরী (১৯৪৩-২০২৩), শিল্পী রফিকুন্নবী (জ. ১৯৪৩) ও হাশেম খান (জ. ১৯৪১) এবং সাংবাদিক সৈয়দ শাজাহান; তবে প্রধান ছিলেন আল মাহমুদের ‘সাহিত্য প্রেমিক বন্ধু’ সাংবাদিক মুহম্মদ আখতার। এখান থেকেই কাইয়ুম চৌধুরীর (১৯৩২-২০১৪) প্রচ্ছদ আঁকা কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘লোক লোকান্তর’ (১৯৬৩) প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসব সৈয়দ আলী আহসানের সভাপতিত্বে বাংলা একাডেমীতে অনুষ্ঠিত হয়। এভাবে কবির আত্মপ্রকাশ ঘটে সৃষ্টিশীল কাজে ও প্রাতিষ্ঠানিক আবহে।

পত্রিকা থেকে ছুটি নিয়ে কবি কিছুদিন জৈবিক আকর্ষণে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় স্ত্রীর সংস্পর্শে থাকেন। এ সময় কৈশোরের ‘লাল মহোন পাঠাগার’সহ আরো কিছু বই নিয়ে ‘কিশোর প্রগতি মজলিস’ নামে নতুন একটি পাঠাগার স্থাপন করেন। অন্যদিকে কবি আসাদ চৌধুরীর সাহিত্য আড্ডায় কবি মাঝে মাঝে যোগ দিতেন। সেখানেই আহমদ ছফার (১৯৪৩-২০০১) মার্কসীয় রাজনীতি দর্শন, সাহিত্যতত্ত্বের উদ্দীপ্ত আলোচনায় মুগ্ধ হয়ে যান। এ সময় কবিও ছিলেন একই মতাদর্শে বিশ্বাসী।

কবি ‘ইত্তেফাকে’ আবারো ফিরে আসেন এবং প্রীতিপূর্ণ এক পরিবেশে কাব্যচর্চা চালিয়ে যান। ১৯৬৬-তে ছড়াকার ও ছড়া সংকলক এখলাস উদ্দীনের উদ্যোগে চট্টগ্রামের ‘বইঘর’ থেকে সৈয়দ আলী আহসান, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ ও শহীদ কাদরীর একসঙ্গে চারটি কাব্যগ্রন্থ চার রঙের প্রচ্ছদসহ প্রকাশিত হয়। আল মাহমুদের ‘কালের কলস’ (১৯৬৬) প্রকাশ পেলে পঞ্চাশের অন্যান্য কবিদের সাথে তাঁর স্বাতন্ত্র্য স্বীকৃতি লাভ করে। গ্রামীণ জীবন ও সংস্কৃতি এবং সেখানে ফিরে যাওয়ার প্রসঙ্গ তাঁর কবিতায় নতুন কাব্যভাষায় উপস্থিত। সামরিক সরকার ইত্তেফাক বন্ধ করে দেওয়ায় কবি যখন জীবনের অনিশ্চয়তায় দিন পার করছেন, তখন বাংলা একাডেমীর ১৯৬৮ সালের পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। কবিতায় আল মাহমুদ পুরস্কার পেলে জীবনের মোড় ঘুরে যায়। অন্যদিকে বেকার জীবন থেকে মুক্তি পেতে ‘বইঘর’-এর প্রকাশনার কাজ করতে চট্টগ্রামে চলে যান। এখানেই কবি ‘সোনালি কাবিনে’র সনেটগুচ্ছ ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৬৮ থেকে ৬ ডিসেম্বর ১৯৬৮ সময়ে রচনা করেন। তিনি চট্টগ্রামের লোকসঙ্গীত গায়ক শ্যাম সুন্দর বৈষ্ণব, শেফালী ঘোষ এবং বিখ্যাত বংশিবাদক ও সাহিত্যিক সুচরিত চৌধুরীর সংস্পর্শও লাভ করেন। বিশেষভাবে শ্যাম সুন্দরের প্রভাব তাঁর জীবনে সুদূরপ্রসারী।

“অনেক স্খলন থেকে শ্যাম সুন্দর বৈষ্ণব সে সময় আমাকে বাঁচিয়ে ছিলেন। আমি যদি তখন কেবল কবির জীবন গ্রহণ করতাম, নিশ্চয়ই আমি ধ্বংস হয়ে যেতাম। ‘সোনালি কাবিন’ নামক একটি কাব্যগ্রন্থ শুধু পেছনে পড়ে থাকত। কিন্তু শ্যামের আধ্যাত্মিকতার প্রভাবে আমি পিচ্ছিল ধ্বংসের পথ থেকে ফিরে এসেছি।”

‘সোনালি কাবনি’ কবিতাগুচ্ছ সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত ‘সমকাল’ পত্রিকায় দুই কিস্তিতে সাতটি করে ছাপা হয়। যদিও আগে থেকেই ‘সমকালে’ তাঁর কবিতা প্রকাশিত হতে থাকে। বিশেষভাবে ‘সমকালে’র ‘কবিতা সংখ্যা’য় (১৯৬৫) তাঁর নয়টি কবিতা মুদ্রিত হয়। ‘ইত্তেফাক’ পুনরায় চালু হলে কবি ঢাকা ফিরে এসে মোহাম্মদ তোহা খানের সহায়ক হিসেবে যোগদান করেন এবং তাঁর ব্যক্তিত্ব ও সাম্যবাদী রাজনৈতিক আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে ওঠেন। এ সময় তিনি ‘সোনালি কাবিনে’র সাম্যবাদী ধারার কবিতাবলী লেখেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে কবি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। কলকাতার কবি-সাহিত্যিকদের সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাৎ ও ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় (১৯৩৪-২০১২), নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী (১৯২৪-২০১৮), কবিতা সিংহ (১৯৩১-৯৯), পূর্ণেন্দু পত্রী (১৯৩১-৯৭), কমল কুমার মজুমদার (১৯১৪-৭৯), মৃণাল সেন (১৯২৩-২০১৮) প্রমুখ সৃষ্টিশীল ব্যক্তিদের সঙ্গ সেই সময়ে কবির অসহায়তা ও অনিশ্চয়তা দূর করতে বিশেষ কাজে দিয়েছে। ‘অরুণা প্রকাশনী’ থেকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সহোযোগীতায় ‘লোক লোকান্তর’, ‘কালের কলস’, ‘সোনালি কাবিন’-এই তিনটি গ্রন্থ মিলে ‘আল মাহমুদের কবিতা’ (১৯৭১) প্রকাশ পেলে কলকাতায় কাব্য জগতে কবিকে নিয়ে নতুনভাবে আলোচনা ও মূল্যায়ন শুরু হয়। এ সময় ‘বেঙ্গল পাবলিশার্সে’র মনুজ বসুর (১৯০১-৮৭) উদ্যোগে কবিকে ‘জয় বাংলা পুরস্কার’ প্রদান করা হয়। এতে কবি আরো বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন।

যুদ্ধ শেষে দেশে ফিরে কবি বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের মুখপত্র ‘দৈনিক গণকণ্ঠ’ সম্পাদনার ভার গ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের মেধাবী ছাত্র ও ছাত্রলীগ নেতা আফতাব আহমাদের (১৯৪৯-২০০৬) সহযোগিতা ও সাহসে এবং আ স ম আবদুর রব (জ. ১৯৪৫), সিরাজুল ইসলাম খান (১৯৪১-২০২৩), কাজী আরেফ আহমেদ (১৯৪২-১৯৯৯), গোলাম আম্বীয়া প্রমুখের সম্মতিতে কবি এই পত্রিকা সম্পাদনার কাজ চালিয়ে যান। ১৯৭৩ সালে ‘সোনালি কাবিন’ স্বতন্ত্র কাব্যগ্রন্থরূপে প্রকাশিত হয়। পত্রিকা সংক্রান্ত শত ব্যস্ততা ও সহিংস রাজনৈতিক ঘটনাবলী কবিকে কাব্যচর্চার নিরিবিলি পরিবেশ থেকে বঞ্চিত করে রাখে। তবুও জীবনের শঙ্কা নিয়ে তিনি কবিতা লেখা ছেড়ে দেননি।

আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে আমাকে গুপ্ত ঘাতকদের হাতে প্রাণ দিতে হবে। কিন্তু যে কোনো কারণেই হোক হার মানা আমার স্বভাবের মধ্যে স্থান করে নিতে পারেনি। এই সব ঘটনাবলির তরঙ্গে আমি লুটোপুটি খেতে খেতে এগিয়ে চলছিলাম। অবস্থাটা জীবনানন্দ দাশের হাঙ্গরের ঢেউয়ে লুটোপুটি খাওয়ার মতো অবস্থা। কিন্তু একটা বিষয়, আমাকে মনে হতো দৈব সাহায্যপ্রাপ্ত ব্যক্তি। কবিতা লিখতে পারছিলাম। আর তা হয়ে উঠছিল অত্যন্ত নির্ভুল সময়ের সাক্ষীর মতো।
এই অস্থিরতার মাঝেই ‘জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল’ (জাসদ: ৩১ অক্টোবর, ১৯৭২) গঠিত হয়; সরকার ‘দৈনিক গণকণ্ঠ’ বন্ধ এবং কবিসহ অনেককে বন্দী করে। দীর্ঘ এক বছর অত্যন্ত কষ্টে কবি জেলজীবন অতিবাহিত করেন। জেলখানায় থাকাকালে (১৯৭৪-৭৫) কবি ধর্মগ্রন্থগুলোর একটা তুলনামূলক পাঠের সুযোগ পান। গণমানুষের মুক্তির একমাত্র মতবাদ হিসেবে তিনি যে সমাজতন্ত্রকে একসময় আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ করেন; তুলনামূলক পাঠের ফলে সেই বিশ্বাস থেকে সরে আসেন। মানুষের সৃষ্ট কোনো মতাদর্শে মানুষের মুক্তি সম্ভব নয় বলে তিনি মনে করেন। সে কারণে তিনি জীবনদর্শন ও জীবনাদর্শ হিসেবে সমাজতন্ত্রের বদলে ইসলামকে গ্রহণ করেন। রচনা করেন ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’; যে কবিতায় কবি মানব জাতির ধ্বংসের মাঝে কোরআনকে বুকে তুলে নেন অর্থাৎ মানবজীবনের মুক্তি পেতে কবি ইসলামী আদর্শকে নির্দ্বিধায় অবলম্বন করেন। জেলখানায় বসেই কবি গদ্যভঙ্গিতে ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’র (১৯৭৬) অধিকাংশ কবিতা লেখন এবং তাঁর এতো দিনের কাব্যধারাকে অতিক্রম করে যান।
আমি দাবি করি, আমি জেলখানায় বসে তিরিশের কবি স্বভাবের বিপরীতমুখী বাক্চাঞ্চল্য সৃষ্টিতে পারঙ্গম হয়েছিলাম।

এ-সময় কবি তিরিশের দশকের বিষয় ও আঙ্গিকগত প্রভাব, প্রবণতা ও বৈশিষ্ট্য ছাড়িয়ে একান্ত নিজস্ব এক কণ্ঠস্বর অর্জন করেন। জীবনের নেতিবাচক অভিব্যক্তি, জনজীবন থেকে বিচ্ছিন্নতা, কলাকৈবল্যবাদিতা, স্বদেশবিমুখতা, উপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদি তিরিশের কাব্যপ্রবণতা থেকে মুক্ত হয়ে দৈশিক পটভূমিকায় তিনি নির্মাণ করেন আপন কাব্যজগৎ; যেখানে স্বদেশের মানুষের পরিবর্তিত জীবনচর্যা, রাজনীতি, যুদ্ধ পরবর্তী সমাজের স্পন্দন, জীবনাদর্শ এবং গদ্যধর্মিতা ইত্যাদির রূপায়ণ ঘটেছে যা উত্তর-উপনিবেশবাদী সাহিত্য হিসেবে গণ্য হতে পারে।
বাংলাদেশের একজন প্রতিনিধিত্বশীল ও অনন্য কবি হয়ে উঠার সঙ্গে সঙ্গে আল মাহমুদের নির্বাচিত কবিতার ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ পায় ১৯৮১ সালে। ভূমিকায় অনুবাদক করীর চৌধুরীর (১৯২৩-২০১১) মন্তব্য তাৎপর্যপূর্ণ:
“I think most people would agree with me when I say that Al
Mahmud is one of the most important living poets of Bangladesh
and that his poetry is unique in many ways.” ২৮

দেশের জীবিত কবিদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও অদ্বিতীয় কবির উপাধি আল মাহমুদের জন্য যথার্থ মূল্যায়ন।

শিল্পকলা একাডেমীতে চাকুরির সুবাদে দেশের বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী, শিল্প সমালোচক, কণ্ঠ-নাট্য-নৃত্যশিল্পী ও যন্ত্রশিল্পীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয়। ফলে শিল্প বিষয়ে তাঁর জানাশোনা ও সিদ্ধি অর্জন করেন।

এখানে সঙ্গীত, চারুকলা, নাট্যকলা, নৃত্যকলা বিষয়ে শিল্পীদের সঙ্গে আমার যে মাখামাখি হয়েছে তাতে আমার নানা বিষয়ে সিদ্ধিলাভ ঘটেছে। এখান থেকে শিক্ষণীয় বিষয় আমি শিখে নিয়েছি।

জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা ও অধ্যয়নের মাধ্যমে কবি জীবনের মৌলিক পরিবর্তন ঘটে। ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’র পর কবি একের পর এক সৃষ্টি করেন ‘অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না’ (১৯৮০), ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’ (১৯৮৫), ‘আরব্যরজনীর রাজহাঁস’ (১৯৮৭), ‘প্রহরান্তের পাশফেরা’ (১৯৮৮), ‘একচক্ষু হরিণ’ (১৯৮৯), ‘মিথ্যাবাদী রাখাল’ (১৯৯৩), ‘আমি, দূরগামী’ (১৯৯৪), ‘দোয়েল ও দয়িতা’ (১৯৯৬) নামের কাব্যগ্রন্থ। ‘লোক লোকান্তর’ থেকে ‘দোয়েল ও দয়িতা’ পর্যন্ত কাব্যগ্রন্থগুলো নিয়ে ‘কবিতাসমগ্র’ (১৯৯৭) প্রকাশিত হয়।

‘বারুদ ও গন্ধকের নদী’ সাঁতার দিয়ে একুশ শতকে এসে কবি অর্জন করেছেন একজন মৌলিক, স্বতন্ত্র ও শক্তিমান কবির পরিচয়। রচনা করেন ‘দ্বিতীয় ভাঙন’ (২০০০), ‘নদীর ভিতরে নদী’(২০০১), ‘উড়ালকাব্য’ ‘(২০০৩), ‘না কোন শূন্যতা মানি না’ (২০০৪), ‘বিরামপুরের যাত্রী’ (২০০৫), ‘তোমার জন্য দীর্ঘ দিবস দীর্ঘ রজনী’ (২০০৫), ‘বারুদগন্ধী মানুষের দেশ’ (২০০৬) কাব্যগ্রন্থগুলো। এইসব গ্রন্থ নিয়ে প্রকাশিত হয় ‘কবিতাসমগ্র ২’ (২০০৬)। পরবর্তী কালে আলাদাভাবে ‘নগরীরর কথা নয় চাষবাসের গল্প’ (২০০৭), ‘তুমি তৃষ্ণা তুমিই পিপাসার জল’ (২০০৭), ‘সেলাই করা মুখ’ (২০০৮), ‘তোমার রক্তে তোমার গন্ধে’ (২০১০), ‘পাখির কথায় পাখা মেললাম’ (২০১২), ‘আমি সীমাহীন যেন-বা প্রাচীন বটবৃক্ষের মতো’ (২০১৩) কাব্যগ্রন্থসমূহ প্রকাশ পায়। জীবনের শেষ পর্যায়ে প্রকাশিত হয় মহাকাব্য ‘এ গল্পের শেষ নেই শুরুও ছিল না’ (২০২০)। দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরে প্রকাশিত আল মাহমুদের ছাব্বিশটি কাব্যগ্রন্থ, কবিজীবন ও কাব্যচারিত্র্যের বাঁকবদল নানাভাবে বিন্যস্ত।

সময়ের সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে আল মাহমুদ যেমন কবি হয়ে উঠেছেন, তেমনি একটা নিজস্ব কাব্যাদর্শও বিনির্মাণ করে নিয়েছেন। সব সময় তা একই রকম থাকেনি, রূপের পরিবর্তনও ঘটেছে। জীবনবোধ ও জীবনাদর্শের বাঁকবদলের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর কাব্যরীতির রূপান্তর হয়েছে। তবে মৌলিক প্রবণতা বা বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে কবি আগাগোড়া একই রকম। আল মাহমুদ আজীবন রোমান্টিক ধারায় কাব্যচর্চা করেছেন। কৈশোরে ও যৌবনে মার্কসবাদে বিশ্বাসী হয়েও তিনি কবিতায় রোমান্টিক আদর্শের রূপায়ণ ঘটিয়েছেন। এ নিয়ে অবশ্য তাঁর মাঝে দ্বন্দ্ব কাজ করেছে:

“আশ্চর্যের ব্যাপার মার্কসবাদে বিশ্বাসী হয়েও কবিতায় মার্কসবাদের প্রতিফলন ঘটাতে পারেনি। আমি রোমান্টিক আত্মার মানুষ বলেই হয়তো তা হয়েছিল। তখনকার সমালোচকরা আমার কবিতা নিয়ে অন্তরাত্মার সমালোচনাও করেছিলেন ঠিকমত মার্কসীয় সাহিত্য করতে পারছি না বলে। মুখে মার্কসবাদের কথা বলছি, কিন্তু কবিতা লিখছি রোমান্টিক। এই দ্বন্দ্ব সারাজীবন কাজ করেছে।”৩১

তবে ‘সোনালি কাবিনে’ মার্কসবাদের প্রতিফলন ঘটেছে চূড়ান্তভাবে। প্রথম দুটি কাব্যগ্রন্থ ‘লোক লোকান্তর’ ও ‘কালের কলসে’ এর কোন স্বাক্ষর নেই। এ প্রসঙ্গে একটা কথা স্মরণীয় যে, মার্কসবাদ ও রোমান্টিকতা পরস্পর বিরোধী আদর্শ হিসেবে কবিতায় সব সময় কাজ করে না। মিশ্রণ ও সংশ্লেষণও ঘটে। আল মাহমুদের সাম্যবাদী কবিতায় যেমন রোমান্টিক উপাদান ক্রিয়াশীল।

সাহিত্যতাত্ত্বিক তপোধীর ভট্টাচার্য মনে করেন- “রোমান্টিক নন্দনতত্ত্বের প্রধান স্তম্ভগুলি হল প্রকৃতির সানুরাগ সান্নিধ্য ও তাতে ঐশীসত্তার অনুভব, সৃজনী কল্পনার ক্রমিক ঊর্ধায়ন, প্রখর স্বাতন্ত্র্যবোধ, বহুবিচিত্রের সংশ্লেষণ, প্রতীকিতার রহস্যময় বিন্যাস ও সার্বিক কেন্দ্রিতিগতা”। রোমান্টিক কবিতার বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী আল মাহমুদ রোমান্টিক ধারার কবি। গীতিময়তা (খুৎরপ) এর অন্যতম গুণ। নাতিদীর্ঘ লিরিক কবিতার আঙ্গিক (ঋড়ৎস) তাই এই ধারার কবিতার অবলম্বন। আল মাহমুদ ‘লোক লোকান্তর’ থেকে ‘সোনালি কাবিন’ পর্যন্ত প্রধানত লিরিকধর্মী কবিতা সৃজন করেন। ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’র পর থেকে গদ্যধর্মী কাব্যের সূচনা। গদ্যকবিতার চর্চা পরবর্তীকালে বৃদ্ধি পেলেও গীতল কবিতা তাঁর প্রতিটি কাব্যেই উপস্থিত। কবি সবসময় একজন ‘গীতি কবি’ হিসেবে নিজেকে ভেবেছেন। সে কারণেই তিনি আজীবন ছন্দবদ্ধ পঙক্তি রচনা করেন। সমালোচকের মতে:

“কবি মাত্রই রোমান্টিক, জন্ম-রোমান্টিক, তা নাহলে কবিতা কেন। এমন কি বাস্তববাদী, সাম্যবাদী, শ্রেণী-সংগ্রামী কবিরাও জন্ম-রোমান্টিক। তবে তাদের রোমান্টিকতা আলাদা জিনিশÑ শ্রেণী-সংগ্রামীদের রোমান্টিকতাকে এরিখ মারিয়া রেমার্ক যথার্থই চিহ্নিত করেছিলেন “Romanticism of the Un-Romantics” বলে। আল মাহমুদ প্রকৃতার্থে রোমান্টিকÑ সর্ব সময়েই রোমান্টিক- রোমান্টিকতা তাঁর ঢাল এবং একই সঙ্গে রোমান্টিকতা তাঁর তলোয়ার।”৩৩

রোমান্টিক কবিরা কল্পনাকে (Imagination) কবিতার মূল শক্তি ও নিয়ামক মনে করেন। স্বপ্ন, সৌন্দর্য, অদ্ভুত, বিস্ময় ও অতীতের স্মৃতির মাধ্যমে আত্মমুক্তির জগতে তারা সাঁতার কাটেন। আল মাহমুদের দৃষ্টিতে কবিতা হলো কল্পনা ও স্বপ্নের ভাষিক শিল্প।

“আমার দৃষ্টিতে কবিতা হলো মানবজীবনের সবচেয়ে নিগূঢ় স্বপ্ন, কল্পনার ভাষার রূপ। ছন্দবদ্ধ ভাষা। আমি মনে করি কবিতা হলো একটা জীবনের নিগূঢ় উপলব্ধি। ছন্দবদ্ধভাবে সুন্দর ভাষায় উপমা-উৎপ্রেক্ষাসহ প্রকাশিত ভাষাই হলো কবিতা। যে জীবন আমরা যাপন করতে পারি না কিন্তু স্বপ্নে করি। স্বপ্নে আমি চিন্তা করি এই রকমই আমিÑ এই স্বপ্নটার রূপই হলো আসলে কবিতা, যা আমরা শব্দে প্রকাশ করি।”৩৪

অর্থাৎ কবির বিবেচনায় কবিতা আর রোমান্টিক কবিতা অভিন্ন। এই ধারার কাব্যে ব্যক্তিই প্রধান এবং ব্যক্তির ভাবনায় কল্পনা কেন্দ্রবিন্দু। কল্পনাশক্তির আলোয় কবি ভেতরের ও বাইরের জগতকে দেখেন এবং নিজের মতো সাজান। আল মাহমুদের কবিসত্তা এবং তাঁর কবিতার কেন্দ্রবিন্দুতে কল্পনা শক্তির অবস্থান ও বিচ্ছুরণ অনুভব করা যায়।

জীবনানন্দ দাশের মতো আল মাহমুদও মনে করেন, “কল্পনাশক্তি জ্ঞানের ব্যাপকতার সংমিশ্রণের নামই হলো প্রেরণা।”৩৫ তিনি প্রেরণায় বিশ্বাসী কবি; কাব্যসৃজনে প্রেরণাকে তিনি আত্মীকরণ করে নিয়েছেন শিল্পবোধ দিয়ে। প্রেরণার সঙ্গে অভিজ্ঞতা, শব্দবোধ, ছন্দ ও অলঙ্কার জ্ঞানের মিশ্রণে তাঁর হাত দিয়ে কবিতার জন্ম হয়। কবি একে ‘অলৌকিকের কাছাকাছি’ হিসেবে অভিহিত করেন।৩৬

রোমান্টিক ধারার কবি হলেও আল মাহমুদের কবিতায় ক্লাসিক কবিতার বৈশিষ্ট্যও রয়েছে। ক্লাসিক ধারার কবিতার মধ্যে সংযত ও সংহত কল্পনা, স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন দৃষ্টি, প্রশান্ত ও আত্মস্থ মনোভাব, ঐতিহ্যানুসরণ, আঙ্গিকের সংবদ্ধতা-দার্ঢ্যতা ইত্যাদি গুণাবলী লক্ষণীয়। আল মাহমুদের দৃষ্টিভঙ্গি, ভাবাবেগ বা চেতনার দিক থেকে রোমান্টিক এবং প্রকরণের বা কাব্যরীতির দিক থেকে ক্লাসিক। ছন্দ-মিলের বন্ধনের মাধ্যমে আঙ্গিকের ক্ষেত্রে তাঁর কবিতায় সংবদ্ধতা বর্তমান।

‘সোনালি কাবিন’ পর্যন্ত তাঁর কবিতায় পয়ার, মাত্রাবৃত্ত ও স্বরবৃত্ত ছন্দের ব্যাপক প্রয়োগ হয়েছে। ফলে কবিতায় রূপবন্ধে দৃঢ়তা ও দার্ঢ্যতা এসেছে। ভাবাবেগ ছন্দ-মিলের কূল ছাপিয়ে ভেসে যেতে পারেনি। এ ক্ষেত্রে তাঁর সনেটের কথা উল্লেখ করা যায়। তাঁর প্রতিটি কাব্যেই সনেটের গাঢ় বুননের বা রূপবন্ধনের চর্চা করেছেন।

ঐতিহ্যানুগত্য ক্লাসিক ধারার কবিতার অন্যতম গুণ। আল মাহমুদের কবিতায় ব্যাপকভাবে ঐতিহ্যানুসরণ করা হয়েছে। তাঁর কাব্যে ভারতীয়/বাঙালি, সেমেটিক ও লোকঐতিহ্য- এই তিন ধারার মিশ্রণ ঘটেছে। ঐতিহ্য রূপায়ণের প্রশ্নে তাঁর মাঝে অত্যন্ত সচেতনভাবে সৌন্দর্যতত্ত্বের (অংঃযধঃরপং) ধারণা কাজ করেছে।

আধুনিক মানুষ যেমন বিচিত্রগামী, আধুনিক কবিতাও তেমনি বৈচিত্র্য-সন্ধানী। পৃথিবীর বিভিন্ন সভ্যতা-সংস্কৃতি-সমাজ-ইতিহাসের প্রতি আধুনিক কবির তৃষ্ণা, আকর্ষণ ও প্রীতি থেকেই তাঁর কবিতার নানা ধারার সঙ্গম ঘটে। রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-জীবনানন্দ-জসীমউদ্দীনের কাব্যে এর দৃষ্টান্ত স্থাপিত। আল মাহমুদ পূর্বসূরী কবিদের সম্পদ আত্মস্থ করেই কবি হয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, জসীমউদ্দীন, ফররুখ আহমদÑ এইসব কবির নানা প্রভাব নানাভাবে তাঁর কবিতায় বিন্যস্ত। এ ছাড়া জার্মান কবি মারিয়া রিলকে (১৮৪৫-১৯২৬), স্প্যানিস কবি গার্সিয়া লোরকা (১৯৯৮-১৯৩৬) এবং ফরাসি কবি শার্ল বদলেয়ারের (১৮২১-১৮৬৭) প্রভাব বা ঋণ তিনি স্বীকার করে নিয়েছেন। পশ্চিমবাহিত তিরিশের আধুনিকতাবাদ থেকে ‘সোনালি কাবিনে’র স্বাতন্ত্র্য কবি শনাক্ত করেন: “সোনালি কাবিন’ আধুনিক কাব্যধারায় একটি স্বতন্ত্র বই। তিরিশের কাব্যধারার পরবর্তী কবিদের হাত দিয়ে এসেছে” ।৩৭

পৃথিবীর নানা সভ্যতা ও সংস্কৃতির ঐতিহ্য এবং নানা ভাষার কবিদের কাব্যধারার ঐতিহ্য আল মাহমুদ নিজস্ব আঙ্গিকে গ্রহণ করেছেন এবং সমৃদ্ধ হয়েছেন। ফলে একদিকে আপন সংস্কৃতির ভিত্তি, অন্যদিকে আন্তর্জাতিকতার সঙ্গে দেশজতার একটা সমন্বয় ঘটেছে তাঁর কবিতায়। (চলবে)

* ড. ফজলুল হক তুহিন কবি ও গবেষক, কালজয়ী কবি আল মাহমুদের কবিতা ও কথাসাহিত্য নিয়ে পিএইচডি, শিল্প-সাহিত্যের কাগজ ‘নতুন এক মাত্রা’র নির্বাহী সম্পাদক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *