আল মাহমুদের সোনালি কাবিন ।। ড. ফজলুল হক তুহিন

শিল্প-সংস্কৃতি সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

(পূর্ব প্রকাশের পর)

দুই

আল মাহমুদ : কবি হয়ে ওঠা

আল মাহমুদ বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান কবি। বায়ান্নোত্তর সময়পর্বের বাংলা কবিতায় তিনি নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি এবং নতুন মাত্রা সংযোজন করেন। আধুনিক বাংলা কাব্যের তিরিশের দশকের প্রবণতার মধ্যেই তাঁর কবিতায় ভাটি-বাংলার জনজীবনের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, নদীকেন্দ্রিক জনপদের নর-নারীর আন্তঃসম্পর্ক, নাগরিকতার বিপরীতে গ্রামসভ্যতায় প্রত্যাবর্তন, নানা ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির রূপায়ণ এবং সমকালীন সমাজ, রাজনীতি ও সময়ের স্পন্দন শিল্পরূপে প্রকাশিত।

বাংলাদেশের কবিতায় কবি আল মাহমুদের উত্থান পঞ্চাশ দশকের মাঝামাঝি। একজন স্বতন্ত্র কবি হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন ঢাকা ও কলকাতার বিভিন্ন পত্রিকায় কবিতা প্রকাশের মাধ্যমে। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘লোক লোকান্তর’ প্রকাশ হলে তাঁর স্বকীয় কণ্ঠস্বর পাঠকসমাজে সহজে গৃহীত ও স্বীকৃত হয়। বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলন, ষাটের দশকের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, স্বাধিকার আন্দোলন এবং চূড়ান্ত মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে সমাজ, রাজনীতি, সংস্কৃতি ও জনমানসের যে ব্যাপক রূপান্তর ঘটে তাকে ধারণ ও ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার অর্জন করে তিনি একজন পরিপূর্ণ কবি হয়ে ওঠেন।

মৌলিক সৃষ্টিকর্ম, নিজস্ব কাব্যভাষা ও আঙ্গিক সৃষ্টি এবং পরিবর্তমান দৈশিক ও বৈশ্বিক প্রেক্ষিতে কবি আপন কাব্যজগৎ নির্মাণ করতে সক্ষম হন। দীর্ঘ পাঁচ দশকব্যাপী কাব্যচর্চার মধ্য দিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান, প্রতিনিধিত্বশীল ও মৌলিক কবি। তাঁর কাব্যযাত্রা ও কাব্যসৃষ্টি আধুনিক বাংলা কবিতার অপরিহার্য অংশে পরিণত হয়েছে।

কবি প্রতিভা নিয়ে জন্ম নিলেই কেউ কবি হয় না। প্রতিভা বিকাশের শর্ত পূরণ হলে তবেই সে কবি হয়ে ওঠে। আল মাহমুদের কবি হয়ে ওঠার পেছনে কয়েকটি বিষয় নিয়ামকরূপে কাজ করেছে। ক. পারিবারিক আবহ, খ. প্রকৃতিলগ্নতা, গ. ব্যাপক অধ্যয়ন, ঘ. নারী সঙ্গলাভ এবং ঙ. সৃষ্টিশীল ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শ।

আল মাহমুদের জন্ম ১১ জুলাই, ১৯৩৬ সালে; সাবেক কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের মৌড়াইল গ্রামের মোল্লা বাড়িতে। সম্পূর্ণ নাম মীর আবদুস শুকুর আল মাহমুদ, ডাক নাম পিয়ারো। পিতা মীর আবদুর রব, মাতা রওশন আরা মীর, পিতামহ মীর আবদুল ওহাব, দাদি হাসিনা বানু এবং প্রপিতামহ মীর মুনশী নোয়াব আলী।

ব্রিটিশ উপনিবেশকালে মুনশী নোয়াব ইংরেজি স্কুলে পড়াশোনা শেষ করে স্থানীয় আদালতে চাকুরি গ্রহণ করেন। স্থানীয় ধনী ব্যবসায়ী মাক্কুমোল্লার কন্যাকে বিয়ে করে স্থায়ীভাবে তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বসবাস শুরু করেন। কবির দাদা আবদুল ওহাব একজন লোককবি ছিলেন। তিনি জারিগান লিখতেন; আরবি ও ফারসি ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন এবং সংস্কৃত জানতেন।

লাঠিখেলা, তরবারি চালনা ও পশু-পাখি পোষা ছিলো তাঁর সখ। ধর্মপ্রাণ হলেও তিনি গান-বাজনা ভালোবাসতেন। কবির দাদি দীর্ঘাঙ্গি, রূপসী ও অত্যন্ত ব্যক্তিত্বশালী মহিলা ছিলেন। বাইরের জগতে দাদার সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড এবং বাড়ির ভেতরে দাদির মুখে শোনা কিচ্ছা-কাহিনীতে কবির শৈশব দারুণভাবে আলোড়িত হয়। দাদির স্নেহ-মমতা ও ইতিহাস-ঐতিহ্যের গল্প তাঁর শিশুমনে প্রভাব বিস্তার করে।

“ আমার শৈশব তার উষ্ণ স্নেহের ক্রোড়ে অতিবাহিত হয়েছে। আমার অতি শৈশবের স্মৃতি বলে যদি কিছু থাকে তা হলো আমার দাদীর সেই পবিত্র মুখাবয়ব। পান খাওয়া লাল দুটি সুন্দর ঠোঁট ও তার মুখ নিঃসৃত অদ্ভুত সব রূপকথা। সিলেটে মুসলিম বীরদের আগমনকালের রোমাঞ্চকর কাহিনীর ভাণ্ডারও যেন তার কাছে গচ্ছিত ছিলো। পরতে পরতে তিনি মেলে দিতেন ধর্মীয় আত্মত্যাগের সেই ইতিহাস।” ৪

শৈশবেই মোল্লাবাড়ির সবচেয়ে উঁচু মজবুত ও কারুকার্যময় ঘরে কবির বসবাসের সুযোগ হয়। তাঁর শৈশবের সমস্ত স্বপ্ন ও কল্পনা প্রবণতাকে অধিকার করে ঘরটি। এই ঘরের জানালা দিয়ে কবি দাদির কোলে শুয়ে এ দেশের বিশাল বৈচিত্র্যময় আকাশ অবলোকন করেন। শিশুমনের স্বাপ্নিক অভিপ্রায় সেই আকাশের নীলিমায় উড়াল দিতো। দাদির মৃত্যু সেজন্যে তাকে প্রবলভাবে ধাক্কা দেয়। কবি শৈশবের অদৃশ্য খোলস ছাড়িয়ে কৈশোরে পদার্পণ করেন।

আল মাহমুদ বাইরের জগৎ ও প্রকৃতির সান্নিধ্য লাভ করেন কৈশোরে, বাড়ির কাজের মেয়ে আলেক জান বা আলকির মাধ্যমে। তাঁর কৈশোরিক সঙ্গী ও শিক্ষকের ভূমিকায় সেই নারী কবিমনে সমুজ্জ্বল।

কবির ভাষায়: “আলকি ছিলো আমার ক্ষণস্থায়ী যাযাবরী ভগ্নী, ধাত্রী, সঙ্গিনী আর শিক্ষয়িত্রী। আমাদের প্রাচীন মধ্যযুগীয় বাড়িটার চৌহদ্দির বাইরের পৃথিবী ও প্রকৃতির প্রধান অধ্যাপিকা। সে আমাকে শিখিয়েছিল ফড়িং আর ফুল-পাখিদের নাম। গাঁয়ের ঘরে-ঘরে বারান্দায় সে আমাকে পৌঁছে দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিলো, আমাদের পরিবারের বাইরেও অন্য ধরনের মানুষ আছে। বর্ষা-বাদলের দিনে কেয়ার ঝাড় থেকে কাঁটার ঘা অগ্রাহ্য করে সে আমাকে এ দেশের সবচেয়ে সুগন্ধি ফুল এনে দিতো। বুকের ভেতর লুটিয়ে নিয়ে আনতো বেতফল। বনবাদাড় ঘুরে কত বুনো ফলের কষটে স্বাদের সাথে যে সে আমাকে লালাযুক্ত করে তুলেছিলো, আর শিখিয়েছিল কত অখাদ্যের ভর্তায় নুন মাখাতে, তার কোন ইয়াত্তা নেই। আলকি ছিলো আমার কাছে এক পূর্ণ মানবীর প্রতিচ্ছবি।” ৫

মায়ের সাথে কবির সম্পর্ক ছিলো দূরের; কাছে ভিড়তেন না খুব একটা। ফলে অন্য নারীদের প্রতি এক ধরনের টান কবি অনুভব করেন। শৈশব-কৈশোরে কবির মানস গঠনে মহরম মাসে সংগঠিত বিভিন্ন খেলাধুলা ও গান-বাজনা প্রভাব বিস্তার করে। মুসলিম ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এতে জাগ্রত হয়। এই পারিবারিক আবহাওয়া, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও পরিবেশের মাঝে বেড়ে ওঠা কবির মানসগঠনে সহায়তা করেছে।

আল মাহমুদের কবিতার একটা বড় জায়গা জুড়ে আছে নদী, নদীতীর ও নদীনির্ভর মানুষ ও প্রাণীকূল। শৈশবের নদী তিতাস তাঁর সারা জীবনের কাব্যযাত্রার সঙ্গী। এই তিতাসের সঙ্গে তাঁর মনপ্রাণের এবং নদীকেন্দ্রিক লোকঐতিহ্যের সংযোগ ঘটে শৈশবেই।

“এ আমার জীবনের প্রথম নদী। নৌকা বাইচের সময় ছাড়া এ নদীর কাছে আসার আমার কোনো উপায় ছিল না। অথচ উপকথা ও এ অঞ্চলের অসংখ্য লোকগাঁথায় তিতাস তার স্বচ্ছ ঢেউ তুলে ক্রমাগত বয়ে গেছে। আমাদের বাড়ি থেকে মাত্র কোয়াটার মাইল দূরে এর প্রবাহ। ঘুঘু পাখির চোখের মত স্বচ্ছ এর পানি। স্রোত আছে কি নেই ঠিকমত ঠাহর করা যায় না। ঢেউয়ের ভেতর হাত নামালে অকস্মাৎ বোঝা যায় অতলে অন্তরালবর্তী স্রোত বয়ে যাচ্ছে। এই নৈশব্দের নদীতে স্নান, পান ও সাঁতার কেটে বেড়ে উঠেছেন কত কবি, সংগীতজ্ঞ ও লোকগায়ক।” ৬

এই নদীর সঙ্গে সখ্যতা কবির গড়ে ওঠে অগ্রজ কবি-শিল্পীদের কথা স্মরণে ও অনুপ্রেরণায়। তিনি নদীর স্রোতে নৌবিহারে গিয়ে ভাটি বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে অবগাহন করেন। তাঁর কাব্যে প্রকৃতির যে বিপুল উপস্থিতি তা মূলত নদীকেন্দ্রিক এবং এই প্রকৃতি তিনি পেয়েছেন শৈশব-কৈশোরের ভ্রাম্যমাণ দিনগুলোতে।

কবি নিজ গ্রামে প্রকৃতি ও গ্রামের সাধারণ মানুষের সান্নিধ্য পেয়েছেন যথেষ্ট। তিনি আরো গভীরভাবে প্রকৃতি ও প্রাকৃতজনের কাছাকাছি আসেন, যখন চাচা-চাচির সাথে দাউদকান্দির জগতপুর গ্রামে বসবাস শুরু করেন। তাঁর কবিতায় পশু-পাখি, নিসর্গ, ফুল-পতঙ্গ, সাপ প্রভৃতির যে বর্ণাঢ্য উপস্থিতি ও লিপ্ততা সেটা এই গ্রামীণ পরিবেশ থেকেই তিনি পেয়েছেন।

প্রকৃতি ও প্রকৃতিলগ্ন জীবনের সঙ্গে কবি ঘনিষ্ঠভাবে মিশে গিয়েছিলেন। অসংখ্য নদী ও বিল-হাওড়ে মানুষের আহার্যের সন্ধান সম্পর্কে তিনি জেনেছিলেন। নৌকা বাইতে, দাঁড় টানতে, জাল ছড়াতে, বড়শি বাইতে, কুচ বা চল দিয়ে ধাবমান মাছ গেঁথে ফেলতে অর্থাৎ মাছ শিকারের যাবতীয় পদ্ধতি শিখেছিলেন। গ্রামের হাটে হাটে ঘুরে কিষাণ জীবনের প্রয়োজনীয় সবকিছুর সঙ্গেও তাঁর পরিচয় ঘটে। সঙ্গে সঙ্গে নিম্নবর্গের মানুষ; যেমন: জেলে, জোলা, কিষাণ, তাঁতি, কামার-কুমার, প্রায় সকল শ্রেণীর মানুষের মাঝে অবাধে তাঁর মেলামেশার সুযোগ হয়েছে।

সীতাকুণ্ডে এসে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তাকে অভিভূত এবং তাঁর একাকীত্ব অধিকার করে। শম্ভুনাথ পাহাড় বা চন্দ্রনাথ পাহাড়ের গা বেয়ে তিনি উপরে উঠে যেতেন। এক কথায়, প্রকৃতি ও প্রাকৃতজনের সঙ্গে খুব কাছাকাছি থেকে তাঁর উপভোগ, উপলব্ধি ও পরিচয় ঘটে।

ঢাকায় বসবাসের পর থেকে আর কোনদিনই তিনি এই সুযোগ পাননি। কৈশোরিক কালে কবিজীবনের অর্জিত এই অভিজ্ঞতা ও অভিজ্ঞান তাঁর কাব্যের মৌলিক ও প্রধান উপাদান হিসেবে কাজ করেছে। অন্যদিকে কৈশোরেই সঙ্গীতের সঙ্গে তাঁর অন্তরঙ্গভাবে ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঐতিহ্যবাহী খাঁ পরিবারের ওস্তাদদের সুর ও সঙ্গীতর তরঙ্গ তাঁর কিশোর মনে প্রভাব ফেলে।

আল মাহমুদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জীবন নানা ঘাত-প্রতিঘাতে মাধ্যমিক স্তরের বেশি এগোয়নি। স্থানীয় মসজিদে ইমামের কাছে তাঁর ধর্মীয় শিক্ষা, দাদির কাছে প্রথম বর্ণ পরিচয় এবং গৃহশিক্ষক শফিউদ্দিন আহমদের কাছে পড়ালেখার সূচনা। গৃহশিক্ষকের কাছেই তিনি প্রথম বাংলার আদি রূপকথার জগত ‘ঠাকুর মার ঝুলি’তে প্রবেশ করেন। লোককাহিনীর যে রঙিন ভুবনের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ ঘটেছিলো শৈশবে, তা পরবর্তী কাব্যজীবনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ‘এম. ই. স্কুলে’ তাকে প্রথম ভর্তি করা হয়। এখানে ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার পর ভর্তি করা হয় সপ্তম শ্রেণীতে ‘জর্জ সিক্সথ হাই স্কুলে’; এরপর কুমিল্লার দাউদকান্দির ‘সাধনা হাইস্কুল’; চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের ‘সীতাকুণ্ড হাইস্কুল’ এবং শেষে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ‘নিয়াজ মোহাম্মদ হাইস্কুলে’ লেখাপড়া করেন। শুরু থেকেই স্কুলের পড়াশুনা তাঁর মোটেই আকৃষ্ট করেনি। পাঠ্য বইয়ের বাইরের জগৎ ও অপাঠ্য বইপত্র তাকে প্রবলভাবে হাতছানি দেয়।

“ আমার স্বাধীনতার কোনো সীমা নেই। স্কুলে ঠিকমত গেলেও সবগুলো ক্লাস ঠিকমত করি না। এর মধ্যে আমার এক নতুন বিষয়ের দিকে ঝোঁক পড়লো, নেশার মত পেয়ে বসলো রোমাঞ্চকর বই পড়ার অভ্যাস। আর ছুটির দিনে গুলতি নিয়ে পাখি শিকারের সখ।” ৮

স্কুল পালিয়ে বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা আর ‘বালসুলভ এ্যাডভেঞ্চারের গালগল্প’তে কবির দিন কেটে যায়। কবি ও তাঁর বন্ধুদের একমাত্র পাঠ্য বিষয় হয়ে ওঠে দুঃসাহসিকতাপূর্ণ উপন্যাস, গোয়েন্দা গল্প ও ভ্রমণ কাহিনী। তাদের স্বপ্ন ছিলো বাড়ি থেকে দেশ-দেশান্তরে পাড়ি জমানো, যে স্বপ্ন স্কুলের পাঠ্য বইয়ে তারা খুঁজে পায়নি। সঙ্গে সঙ্গে কবি অর্জন করেন ভাষাজ্ঞান ও শব্দের অন্তর্গত অর্থ।

অপাঠ্য বই-ই কবিকে বন্ধুত্ব ও স্বাভাবিক পরিবেশ থেকে পৃথক করে দেয়। কৈশোরিক খেলাধুলা ও আনন্দ-ফূর্তির মুহূর্ত থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে কবি আশ্রয় নেন ‘চাঁদের পাহাড়’, মার্কোপলোর ভ্রমণ বৃত্তান্ত, পৃথিবীর মানচিত্র, জাতিবর্ণের পরিচয়, ভাষা, পোশাক, প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং রহস্যময় ভৌগোলিক বিবরণের জগতে। ব্যতিক্রম আচরণের কারণে সমাজে-বন্ধুমহলে তাঁর উপাধি হয়ে যায় ‘কবি’।

বইয়ের টানেই বিচিত্র মানুষজনের সাথে কবির পরিচয় ঘটে। পরিচয়ের সূত্র ধরে তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৪-১৯৫০), শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৭৬-১৯৩৮), কাজী নজরুল ইসলাম, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৮-১৯৭১), বনফুল (১৮৯৯-১৯৭৯) প্রমুখের সাহিত্যে প্রবেশ করেন। ডিটেকটিভ (Ditactive) উপন্যাস ও এ্যাডভেঞ্চারের (Adventure) গল্পের সীমা ছাড়িয়ে তিনি ধীরে ধীরে মননশীল ও উঁচু স্তরের সৃজনশীল সাহিত্যের পাঠ শুরু করেন।

এ ক্ষেত্রে স্থানীয় ‘লালমোহন স্মৃতি পাঠাগার’ অগ্রণী ভূমিকা রাখে। এই পাঠাগারের উদ্দেশ্য ছিলো মার্কসবাদী আদর্শে উজ্জীবিত করা এবং সে অনুযায়ী বইপত্রের ভাণ্ডার গড়ে তোলা। কবি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েন এই পাঠাগারের সঙ্গে। শহরের অনেক উদীয়মান লেখক ও সঙ্গীত-প্রতিভার সঙ্গে, যারা এর সাথে জড়িত ছিলেন; তিনি নিজেও দীক্ষিত হয়ে যান বাম আদর্শে। পারিবারিক ঐতিহ্য ও মতাদর্শের মৌলিক পরিবর্তন আসে তাঁর মাঝে। ফলে তাঁর চিন্তা ও কর্মের প্রকৃতি সম্পূর্ণ পালটে যায়।

“ মার্কসীয় দৃষ্টিকোণ ও সাম্যবাদ প্রচারেই এর পুস্তক সম্ভার সজ্জিত ছিল, তবুও এ কথা স্বীকার না করে পারি না, আমার জীবনের সাত্যিকার শিক্ষা, গবেষণা ও অনুসন্ধিৎসার স্বভাব এবং রুচি নির্মাণে এই গ্রন্থাগারটি যে ভূমিকা পালন করেছিল এর কোন তুলনা হয় না। …লালমোহন পাঠাগারের সাথে বেশ ভালোভাবেই জড়িয়ে গেলাম আমি। জড়িয়ে গেলাম এদের রাজনৈতিক আদর্শের সাথেও। বুঝে হোক না বুঝে আমি মার্কসীয় চিন্তা চেতনার ভেতর সমাজটাকে পাল্টে ফেলার একটা রঙিন স্বপ্নের দিকে ডানা মেলে দিলাম। …আমার আচরণ একদম বদলে গেল। আগে যেসব কাজকে আমি গভীর গোনার কাজ মনে করতাম। এখন আর তা তেমন মন্দ রইল না। আমি কখন মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে লেখা ‘ছোটদের রাজনীতি’, ‘ছোটদের অর্থনীতি’, ‘ইতিহাসের ধারা’ ও ‘ডারউইনের বিবর্তন’ বিষয়ক আজগুবী কিচ্ছা-কাহিনী পড়ে বেশ পাক্কা হয়ে উঠেছি।” ৯

এই গ্রন্থাগারের কারণেই তিনি রবীন্দ্র-নজরুল পেরিয়ে তিরিশোত্তর কবি-লেখকদের জগতে প্রবেশ করেন। বিষ্ণু দে, সুভাষ মুখোপাধ্যায় (১৯১৯-২০০৩), সুকান্ত ভট্টাচার্য (১৯২৬-৪৭), মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯০৮-৫৬) প্রমুখ মার্কসবাদী লেখকের রচনাবলির সঙ্গে পরিচয় ঘটে। তবে কাজী নজরুল ইলামের ‘অগ্নিবীণা’র (১৯২২) বিদ্রোহাত্মক এবং জীবনানন্দ দাশের ‘মহাপৃথিবী’র (১৯৪৪) সময়চেতন কবিতাগুচ্ছ তাঁর কৈশোরিক কবিমনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে।

কবি কৈশোরে ‘লালমোহন পাঠাগারে’ ব্যাপক ও গভীরভাবে অধ্যয়নের সুযোগ সম্পূর্ণরূপে কাজে লাগান। অধ্যয়নের সেই ধারাবাহিকতা ঢাকার জীবনে এসে আর থাকেনি। জীবিকার সংগ্রাম, কবি-আড্ডা, অস্থায়ী আবাস এবং উত্তাল রাজনৈতিক তরঙ্গে কর্মস্থল ‘দৈনিক ইত্তেফাক’ বারবার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কবি নিরচ্ছিন্নভাবে পাঠচর্চা করতে পারেননি। তবে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান দমনের অংশ হিসেবে তৎকালীন সরকার ইত্তেফাক পত্রিকা বন্ধ করে দিলে কবি চট্টগ্রামে ‘বইঘরে’র প্রকাশনা কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। চট্টগ্রামে থাকাবস্থায় কবির পড়াশোনার বিস্তৃতি ঘটে এবং ব্যাপকভাবে বইপত্রের জগতে প্রবেশ করেন।

“এখানে থাকতেই আমার গভীর গোপন পড়াশোনার একটা অভ্যাস গড়ে উঠেছিল। বইপত্রেরও অভাব ছিল না।” ১০

চট্টগ্রামে প্রকৃতি ও বই পাঠে কবি গভীর জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। বিশেষভাবে বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্য, সাম্যবাদ, সমাজতত্ত্ব, রাজনৈতিক অভিজ্ঞান এবং প্রেমকামের তাৎপর্য মন ও মননে ধারণ করেন। অধ্যয়ন ও অর্জনের প্রেক্ষিতেই তিনি চট্টগ্রামে থাকাবস্থায় রচনা করেন ‘সোনালি কাবিন’ সনেটগুচ্ছের মতো অমর কাব্য।

ঢাকার জীবনে ফিরে এসে কবি কাব্যচর্চায় মন দেন, কিন্তু পাঠের গভীর কোনো সুযোগ তার হয়ে উঠেনি। ১৯৭১-এ সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে আশ্রয় গ্রহণ ও অনিশ্চিত জীবন নিয়ে ফিরে এসে কবি একমাত্র র‌্যাডিকেল পত্রিকা ‘গণকণ্ঠে’র সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। সরকার ১৯৭৪ সালে এই পত্রিকা বন্ধ করে দিয়ে তাকে জেলখানায় এক বছর বিনা বিচারে আটকে রাখে। এখানে কবি আবারো নিবিড়ভাবে অধ্যয়নের জগতে প্রবেশ করেন। বিশেষভাবে বিশ্বের প্রধান ঐশী ধর্মগ্রন্থগুলো তিনি তুলনামূলক পাঠ (Comparative study) করেন। এই পাঠেই তাঁর চিন্তাধারা ও বিশ্বাসে আসে মৌলিক পরিবর্তন।

উত্তরাধিকার, পরিবার ও সমাজ থেকে প্রাপ্ত যে বিশ্বাস-চিন্তাচেতনা-মূল্যবোধ কবি শৈশব-কৈশোরে অর্জন করেন, তা ‘লালমোহন পাঠাগারে’র বইপত্র পড়ে মার্কসীয় চিন্তাধারায় কবি বিশ্বাসী হয়ে ওঠেন এবং ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত লালন করেন। জেল জীবনের গভীর পাঠে কবি আমূল পালটে যানÑ বিশ্বাস, মূল্যবোধ, মনন ও দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে। কবি সম্পূর্ণভাবে ইসলামের প্রতি বিশ্বাসী ও আস্থাশীল হয়ে ওঠেন। ইসলামে আত্মসর্পণের পর বিশ্বখ্যাত ইরানি ইসলামী চিন্তাবিদ আলী শরিয়তির Man and Islam বইটি কবিকে প্রভাবিত করে। তবে অধ্যয়নের বৈচিত্র্য তিনি বর্জন করেননি। হিন্দু ধর্ম ও সংস্কৃতির মৌল গ্রন্থগুলোও তিনি পাঠ করেন।

“ আমার কবিতা এবং অন্যান্য লেখালেখির ক্ষেত্রে বেদ, উপনিষদ এবং হিন্দু পুরাণের যে বিশাল ভাণ্ডার তার কাছে অবশ্যই আমি ঋণী। এখানে বলে নেওয়া যেতেই পারে সঠিক অর্থে সম্ভবত আমি ব্রাহ্মণের অধিক ব্রাহ্মণ। এই উপমহাদেশে বেদ উপনিষদ পুরাণের যে ভাণ্ডার তাকে কোনোভাবেই এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। অত্যন্ত মনোযোগ দিয়েই হিন্দু ধর্মগ্রন্থ, উপনিষদ ও পুরাণ আমাকে পড়তে হয়েছে।”

বিচিত্র পাঠ অভিজ্ঞতা তাঁর চিন্তাচেতনায় বারবার যেমন পরিবর্তন এনেছে, তেমনি কবিতায় বৈচিত্র্যময়তাও ঘটেছে। মার্কসবাদ, ইসলাম ও অন্যান্য ধর্মগ্রন্থ এবং পৌরাণিক-লৌকিক বিষয়াদির বইপত্র কবিকে মেধা-মনন-প্রজ্ঞায় ঋদ্ধ করেছে; সঙ্গে সঙ্গে বাঙালি হিন্দু ও বাঙালি মুসলমানের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে ধারণ করে দায়বদ্ধতার পরিচয় দিয়েছেন। এক কথায়, অধ্যয়নেই বারবার কবি জীবন ও চিন্তাস্রোতের বাঁকবদল ঘটেছে।

মার্কসবাদী আদর্শের পথ ধরেই কবি মাকর্সবাদী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন কৈশোরে। নিষিদ্ধ ঘোষিত কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীদের সাথে কবির সখ্যতা গড়ে ওঠে এবং গোপনে শ্রমিক শ্রেণীর মানুষজনের মাঝে সাম্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রচার-প্রপাগাণ্ডায় অংশ নেন। রাজনৈতিক এই সচেতনতা থেকেই কবি বায়ান্নোর ভাষা-আন্দোলনে যোগ দেন ও কর্মতৎপরতা চালাতে থাকেন।

“ বায়ান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারীতে ভাষা আন্দোলনকারী ঢাকার ছাত্র-মিছিলের ওপর গুলি চলার ঘটনাটি যখন সারা দেশকে উত্তপ্ত করে তুললো তখন ব্রাহ্মণ বাড়িয়াতেও এর জের বইতে লাগলো। আমি, তাজুল ও মুসা শহরের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের এক প্রকার নেতৃত্বের স্থানে অধিষ্ঠিত। গান-বাজনা বা কবিতার আসর আমাদের ছাড়া কেউ চিন্তাও করতে পারতো না”

ভাষা-আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটির জন্য চাঁদা সংগ্রহ, রাষ্ট্রভাষার দাবিতে বক্তৃতা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে কবির কৈশোরেই রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ভাষা-আন্দোলন কমিটির লিফলেটে চার লাইনের একটি কবিতা ছাপা হলে তাকে ধরতে বাড়িতে পুলিশ হানা দেয়। ভাষা ও দেশের প্রতি দায় ও প্রেম থেকে কবির রাজনীতিতে সম্পৃক্ততা আসে। পরবর্তীকালে ঢাকার জীবনে গণমানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে বামধারার রাজনীতির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

আল মাহমুদের জীবন ও কাব্যে নারীর প্রভাব ব্যাপক ও গভীর। তাঁর কবিতার প্রধান বিষয় নারী। কবিজীবনে চারজন নারীর প্রভাব বিশেষভাবে পড়েছে। প্রথমত, আলকি, যে নারী কবির জীবনের সূচনালগ্নে শিক্ষকের, বন্ধুত্বের, বোনের ও ধাত্রীর ভূমিকায় অবতীর্ণ। দ্বিতীয়ত, কৈশোরের সঙ্গী শোভা যার বুদ্ধিদীপ্ততা, চাঞ্চল্য, বন্ধুত্ব ও হৃদ্যতা কবিমনে দাগ কেটে যায়। তৃতীয়ত, ‘বিশিদি’ বাঙালি বৌদ্ধ বিধবা এই নারীর স্নেহমিশ্রিত প্রেম, শরীরী আকর্ষণ ও সঙ্গ কবিকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে। চতুর্থত, যে নারী কবিকে সম্পূর্ণভাবে দখল করে নেয়, সে নারী কবির স্ত্রী সৈয়দা নাদিরা বেগম। দৈহিক, মানসিক, আধ্যাত্মিক এবং বৈষয়িক যাবতীয় বিষয়ের কেন্দ্রে এই নারী কবিকে প্রাণিত, প্রভাবিত ও রণিত করেন।

এছাড়া ঢাকা ও কলকাতার জীবনে বেশ কিছু নারী কবির সংস্পর্শে আসে। ‘কাফেলা’র সম্পাদক কাজী নজমুল হকের স্ত্রী কাজী লতিফা হক কবিকে মাতৃ‎েস্নহে সিক্ত করেন। পুরোনো ঢাকায় থাকাকালীন চশমাবিক্রেতা নয়নের সঙ্গে বন্ধুত্ব ও প্রীতির সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ‘ইত্তেফাকে’ চাকুরির সময়ে কবি কাজী রোজীর সঙ্গে কবির হৃদতা ও ঘনিষ্ঠতার বৃদ্ধি পায়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে কবি যখন কলকাতায় ছিলেন তখন কবিতা সিংহ ও সুবীর রায় চৌধুরীর কন্যা রাজেশ্বরী বায় চৌধুরীর (রাজু) মধ্যে গভীর হৃদতার সম্পর্ক তৈরি হয়। তিনি কবিকে ‘মামা’ বলে ডাকতেন এবং কলকাতা শহরের সঙ্গে কবির পরিচয় ঘটিয়েছিলেন। এইভাবে নারীকেন্দ্রিক অভিজ্ঞতা, নারী-পুরুষ সম্বন্ধ, দেহ-মনের সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয়ে কবির জীবনে নারী নিয়ে আসে বৈচিত্র্য ও প্রেরণা। (চলবে)

* ড. ফজলুল হক তুহিন কবি ও গবেষক, কালজয়ী কবি আল মাহমুদের কবিতা ও কথাসাহিত্য নিয়ে পিএইচডি, শিল্প-সাহিত্যের কাগজ ‘নতুন এক মাত্রা’র নির্বাহী সম্পাদক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *