আল মাহমুদের গদ্য ও সাংবাদিকতা

প্রবন্ধ-কলাম সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

মাসুম খলিলী
এক.
কোলাহলপূর্ণ ও গ্রামীণ সংস্কৃৃতির সম্মৃৃদ্ধ জনপদ থেকে উঠে এসে বাংলা কাব্য জগতের শীর্ষে আরোহন করেছিলেন কবি আল মাহমুদ। বৈচিত্রপূর্ণ নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে শৈশব কৈশোর যৌবন পেরিয়ে পরিণত বয়সে উন্নীত এই কবির জীবনের প্রতিটি অধ্যায় ছিল সৃজনশীল কর্মযজ্ঞে ভরপুর। পঞ্চাশের দশকে বাংলা কবিতার ভূবনের আল মাহমুদের যাত্রার বিষয়টি অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। আর যেভাবে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘লোক লোকান্তর’, দ্বিতীয় কাব্য ‘কালের কলস’ এবং আলোচিত কাব্যসৃষ্টি ‘সোনালী কাবিন’ আর কবির মতে শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ ‘মায়াবি পর্দা দোলে উঠো’ কাব্যসাহিত্য রসিকদের মধ্যে আলোড়নের ঢেউ তুলেছিল, তেমনিভাবে প্রথম গল্পগ্রন্থ পানকৌড়ির রক্ত, সৌরভের কাছে পরাজিত বা গন্ধ বণিক বাংলা কথাসাহিত্যে আল মাহমুদের নতুন এক অভিযাত্রাকে অবারিত করে দিয়েছিল। বাংলা কথাসাহিত্যে আল মাহমুদের এই অবস্থানবৃক্ষে গভীরতর শেকড় বিস্তৃত করেছে, ‘উপমহাদেশ’, ‘কাবিলের বোন’, ‘ডাহুকি’ আর আত্ম জৈবনিক উপন্যাস ‘যে ভাবে বেড়ে উঠি’, ‘বিচুর্ণ আয়নায় কবির মুখ’ বা ‘যে পারো ভুলিয়ে দাও’ এর মতো অসাধারণ সৃষ্টি।

দুই.
ষাটের দশকে কবি আল মাহমুদ কার্যকর সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন। সংবাদপত্রের প্রারম্ভিক কাজ সংশোধন বিভাগ থেকে ধাপে ধাপে সহ-সম্পাদক, মফম্বল সম্পাদক এবং এরপর একটি রেডিক্যাল দৈনিকের সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণের এক দীর্ঘ ক্যারিয়ার ছিল আল মাহমুদের সাংবাদিক জীবনের। সম্পাদক হিসাবে কারাগারের জীবনই আল মাহমুদের ব্যক্তি, আদর্শ ও জীবনবোধকে পাল্টে দেয়। কারাগার থেকে বের হয়ে আল মাহমুদের সাংবাদিকতায় যুক্ত হবার মত কোন পেশাগত অবকাশ ছিল না। তখনকার সরকার প্রধান আল মাহমুদকে মনন চর্চার আরেক ক্ষেত্র শিল্পকলা একাডেমির সহকারী পরিচালকের চাকরি দেন। একজন সম্পাদকের জন্য মানানসই দায়িত্ব এটি না হলেও অনানুষ্ঠানিক শিক্ষাসমৃদ্ধ ব্যক্তি হিসাবে আল মাহমুদ সংসার চালানোর জন্য এ কর্মক্ষেত্রকে মেনে নেন। আর এ প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হিসাবে কবি অবসর গ্রহণ করেন।

আল মাহমুদের পেশাগত জীবন গণমাধ্যম থেকে গবেষণা প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর হলেও সংবাদপত্রের সাথে কবির সম্পর্ক বরাবরই চলমান ছিল। নামে বেনামে কলাম প্রবন্ধ নিবন্ধ সাহিত্যালোচনা অব্যাহত থাকে কবির। সংবাদপত্রের ভাষা আর সাহিত্যের ভাষার মধ্যে একটি মৌলিক প্রভেদ সব সময় লক্ষ্য করা যায়। সংবাদপত্রের ভাষার মধ্যে যেখানে যোগাযোগ বা তথ্য আদান প্রদান থাকে মুখ্য, সেখানে সাহিত্য সমাজের সেই অর্থে দর্পণের ভূমিকা প্রত্যক্ষভাবে পালন করে না। সাহিত্য সৃজনশীল কল্পনা আর বাস্তবতার মিশেলে সমাজকে তুলে ধরে ভবিষ্যতের জন্য পথ দেখায়, বিনোদনের উপকরণ হয়, অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যতের সেতু তৈরি করে।

সংবাদপত্রে ও সাহিত্যে ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে এমন কিছু বিষয় রয়েছে যা সংবাদপত্রকে সাহিত্য থেকে আলাদা করেছে। প্রমথ চৌধুরী বলেছিলেন, “ভাষা মানুষের মুখ থেকে কলমের মুখে আসে, কলমের মুখ থেকে মানুষের মুখে নয়।” সাহিত্যের ভাষা কাব্যিক, তথ্য ভিত্তিক বর্ণনাত্মক, বিশ্লেষণাত্মক হতে পারে। কিন্তু সংবাদের ভাষা অবশ্যই তথ্য ভিত্তিক বা তথ্যের বাহক হতে হয়। তবে বর্তমানে ফিচার ধর্মী সংবাদগুলো কিছুটা বিশ্লেষণাত্মক তবে তাও সাহিত্যের মতো কল্পনাশ্রিত নয়।

সাহিত্যের কলেবরে শব্দ চয়ন ও ভাবাবেগ প্রকাশ করা হয়। আর সংবাদপত্রের পাতায় সংবাদের তথ্যগুলো প্রকাশ করা হয়। তা না হলে কোনটা সংবাদ পরিবেশনা আর কোনটি কল্পিত বা রুপায়িত সাহিত্য তা আলাদা করা যাবে না।

সাহিত্যের সুচনা লগ্নে সাহিত্য হয়তো আজকের রূপে ছিল না। সংবাদের শুরুর যুগে সংবাদের ভাষাও আজকের মত ছিল না, বস্তুনিষ্ঠতার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সংবাদপত্র প্রকাশিত হতে শুরু করেছে এমনটাও নয়। তবে অনেকগুলো কারণে সংবাদের ভাষা ও সাহিত্যের ভাষা আলাদা রূপ নিয়েছে। সংবাদপত্রের ভাষার কিছু নিজস্ব বৈশিষ্ট থাকে। যেমন, সংবাদপত্রের ভাষা হয় সহজ, সরল, স্বচ্ছ যেন পাঠক ও শ্রোতা তা সহজেই বুঝতে পারেন। যেহেতু পাঠক-শ্রোতার মধ্যে পন্ডিত যেমন আছেন, তেমনি রয়েছেন নামমাত্র সাক্ষর ব্যক্তিও। তাই এতে ব্যবহৃত ভাষা হয় এমন যেন সকলেই তা বুঝতে পারেন। যদিও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বহুলালোচিত কথা হলো, “সহজ কথা বলতে আমায় কহ যে, সহজ কথা যায় না বলা সহজে।”

আল মাহমুদ তার দীর্ঘ সৃষ্টি জীবনে সাংবাদিকতা ও সাহিত্য চর্চা অব্যাহত রেখে দুটোকে এক সাথে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। আল মাহমুদের মতো আহসান হাবিব, শামসুর রাহমান, ফজল শাহাবুদ্দিন বা আল মুজাহিদীও সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত ছিলেন। তবে তারা আল মাহমুদের মতো তৃণমূল পর্যায়ের সংবাদ সংশোধন, সংগ্রহ ও সম্পাদনা করে সংবাদপত্রের সর্বোচ্চ পদে বসেননি। সংবাদপত্রে তাদের কর্মপরিধির মূল অংশটাই ছিল সাহিত্য পাতা সম্পাদনা অথবা সম্পাদকীয় বা কলাম লেখা পর্যন্ত।

কবি আল মাহমুদ অল্প বয়সেই সাংবাদিকতার সাথে নিজেকে জড়িয়ে নেন। ঘুরে ফিরে তিনি এ পেশাতেই থেকেছেন। সাংবাদিকতাকে তিনি নানাভাবে উপভোগও করেছেন। এ পেশার সকল পর্যায়ে বিভিন্ন সময়ে দায়িত্ব পালন করার কারণে তিনি এর ভেতর বাহির ভাল করে জানেন। তিনি জানেন এর ভাল মন্দ। কবি নিজেই বলেছেন, ‘আমি হঠাৎ একদিন সম্পাদক হয়ে যাইনি, সংবাদপত্রের বিভিন্ন ধাপ অতিক্রম করে এসেছি। এ জন্যে সংবাদপত্রের ভেতরে বাইরে সবটা আমি জানি। সংবাদপত্র কিভাবে গঠিত হয়, কিভাবে পরিচালিত হয়, আমি জানি। সাংবাদিকতায় যতোটা এগিয়েছি তা পরিশ্রমের মধ্যে দিয়ে এসেছি। আমাকে কেউ দয়া টয়া করেনি। নিজের যোগ্যতা ও পরিশ্রমের বলে আমি একটা একটা সীমারেখা পার হয়ে এসে সম্পাদক হয়েছি।’

কবি নিজের জীবন থেকেই অনুভব করেছেন, ‘আসলে সাংবাদিকতার ভেতরে একটা মজা আছে। সে মজাই যদি কেউ একজন নিজে অনুভব করে তাহলে সে সাংবাদিক হতে পারে।’ সাংবাদিক হিসাবে একটি বিশেষ স্মৃতির কথা মাঝে মধ্যেই কবি বলতেন। এক সাক্ষাতকারে সেটি তিনি উল্লেখও করেছেন। তার স্মৃতিচারণাটা ছিল এরকম- “পাকিস্তান আমলের একটা কথা বলি। আমি তখন ইত্তেফাকে মফস্বল এডিটর। মফস্বল এডিটর মানে প্রাদেশিক নিউজের চার্জে আছি। আমার কাছেই সবাই আসে। আমার টেবিলেই সর্বদা ভিড় লেগে থাকে। আর কোথাও ভিড় নেই। এই সময় একটা খবর পাই যে, অভাবের তাড়নায় দেশের উত্তরাঞ্চলের মেয়েরা চুল বিক্রি করে ফেলছে। এটা বাংলাদেশ হবার প্রায় চার বছর আগের কথা। মফস্বল এডিটর হিসেবে আমার কাছেই এই নিউজটা আসে। আমি ওই বিবরণীটার উপর একটা নিউজ দাঁড় করালাম। চুলের ইতিহাস দিয়ে বাঙালী মেয়েদের চুল সম্পর্কে আগে কে কি বলেছেন, অতীত ইতিহাস টেনে একটা নিউজ লিখলাম। লিখে আমি নিউজ এডিটর সিরাজউদ্দীন সাহেবের (শহীদ সাংবাদিক) কাছে গেলাম। উনাকে আমি নিউজটা দিয়ে বললাম, প্রথম পাতায় এটা দেয়া দরকার। তিনি বললেন, ও আচ্ছা দিয়ে দে। তুই মার্ক করে রেখে যা। তিনি আরো বললেন, মফস্বল নিউজ ফাস্ট পেজে দিতে চাস? এরপর পাশের রুমে এসে আমরা সিগারেট খাচ্ছি। উনার সামনে আমরা অনেকেই সিগারেট খেতাম না। সিরাজ ভাই হঠাৎ নিউজটা হাতে নিয়ে উঠে চলে আসলেন। এ রকমটি কখনো তিনি করেন না। এসেই হাঁক ছাড়লেন, কিরে কি করছিস? আমি বললাম, চা খাচ্ছি। আসলে তো সিগারেট খাচ্ছি। ধোঁয়া দেখেই উনি আর ভেতরে ঢোকেননি। শুধু বললেন, একটু আয়। ডাক শুনে আমি তো সিগারেট ফেলে দে দৌড়। আমাকে দেখে বললেন, তোর নিউজটা পড়লাম। হ্যাঁ, এটা লিড নিউজও হতে পারে। তবে তুই নিউজটা আবার পড়। নিউজের ভেতর কিছু ত্রুটি আছে। আমি বারবার পড়ি। বুঝতে পারছি না। এমন ফার্স্ট ক্লাস লিখেছি। আমার গদ্য ভালো, বোঝো না। অহংকারই হলো। সিরাজ ভাই আবার মনোযোগ দিয়ে তা পড়লেন, পরে আমার সামনে এরকম (হাত দিয়ে দেখিয়ে) ঢিল দিয়ে ফেলে দিয়ে বললেন, ভাল করে পড়। আমি আবার পড়লাম, কিছুই ধরতে পারছি না। তখন উনি বললেন কি দেখো, এ দিকে আয় বলে ডাকলেন। উনি যেখানে বসেন তার পেছনে দাঁড় করালেন। আমি দাঁড়িয়ে আছি। উনি শুধু লাস্ট স্লিপটা ছিঁড়ে সেটা সামনে এঁটে দিলেন। বললেন, এটা ইনট্রো কর। এটা ইনট্রো করে পড়তো, পড়লাম। পড়ে একদম বেকুব হয়ে গেলাম। গোটা নিউজটা একদম চেঞ্জ হয়ে গেছে। তখন তিনি বললেন, কি ঠিক আছে? ওকে, এটা সেকেন্ড লিড করে দিলাম। পরের দিন রয়টার ইত্তেফাককে কোট করলো নিউজটার জন্য।’

আল মাহমুদ সাংবাদিক হিসাবে সাপ্তাহিক কাফেলা, দৈনিক মিল্লাত, ইত্তেফাক, গণকণ্ঠ, সংগ্রাম, পালাবদল, কর্ণফুলিসহ বিভিন্ন পত্রিকায় আনুষ্ঠানিক অনানুষ্ঠানিকভাবে কর্মজীবনের নানা সময়ে কাজ করেছেন। শিল্পকলা একাডেমীতে চাকরী করলেও কলামিস্ট হিসেবে তিনি লেখালেখি করতেন। সংবাদপত্রের সাথে তাঁর যোগাযোগ কখনও বিচ্ছিন্ন হয়নি। সাংবাদিকতার জীবন বেছে নেয়ার পেছনে কবি আল মাহমুদের অন্য একটি বিশ্লেষণও রয়েছে। তিনি মনে করেন, “সাংবাদিকতায় একটা প্রাত্যাহিক উত্তেজনা আছে। কালকে যা মানুষ জানবে তা একদিন আগেই সাংবাদিকরা জেনে যায়। সংবাদপত্রে থাকলে এই একরাত এগিয়ে থাকা যায়। এর জন্য সংবাদপত্রের পেশা একটা উত্তেজক পেশা।”

সব মিলিয়ে বলা যায় কবি আল মাহমুদ প্রকৃতপক্ষেই সাংবাদিক কবি। আর কবি হওয়ার কারণে তাঁর গদ্য অসম্ভব শক্তিশালী। আমাদের মতে কবিদের মধ্যে তাঁর রচিত গদ্য সব থেকে উত্তম ও পাঠক নন্দিত। প্রায় অন্ধের মতো অবস্থা হওয়া সত্ত্বেও পত্র পত্রিকায় আমৃত্যু লিখেছেন তিনি। অনুলিখনের মাধ্যমে এসব লেখা পাঠকের সামনে আসতে দেরি হয়নি।
সে যাই হোক আল মাহমুদের সক্রিয় সাংবাদিকতা সময়ের গদ্য চর্চার ভাষা এবং অন্য সময়ের গদ্য ভাষার মধ্যে একটি সুক্ষ্ম পার্থক্যও লক্ষ্য করা যায়। যদিও আল মাহমুদ সাহিত্য চর্চাকে মন ও মননের আকাক্সক্ষা আর সাংবাদিকতাকে সংসার নির্বাহের অবলম্বন হিসাবে বর্ণনা করেছেন।

তিন.
আল মাহমুদ কাব্য চর্চার ক্ষেত্রে যেমন কাঠামোগতভাবে ভাঙা গড়ার পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে এগিয়ে গেছেন, তেমনিভাবে গদ্য চর্চায় আল মাহমুদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার অন্ত নেই। এই পরীক্ষা যেমন গদ্য ভাষায় তেমনিভাবে গল্পের কাঠামো বা বিষয় বৈচিত্র্যেও লক্ষ্য করা যায়। আল মাহমুদের পানকৌড়ির রক্ত গল্পগ্রন্থের গল্পগুলোর ভাষা এবং সৌরভের কাছে পরাজিতের অনেক গল্পের গদ্যভাষা এক দেখা যায় না। আবার আত্মজৈবনিক উপন্যাস, যেভাবে বেড়ে উঠির গল্প কাঠামোতে যেমন বৈচিত্র রয়েছে, তেমনিভাবে এর গদ্যভাষাও একেবারেই আলাদা। এ গদ্যভাষার সাথে মোটাদাগে সৌরভের কাছে পরাজিতের গদ্যভাষার মিল নেই। এমনকি পানকৌড়ির রক্তের গদ্য ভাষার সাথেও এর অধিকাংশ গল্পের ভাষার বেশ কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে।

দৈনিক ইত্তেফাকের মফস্বল বিভাগের সম্পাদক অথবা দৈনিক গণকণ্ঠের সম্পাদকের দায়িত্ব পালনের সময়কালের গল্প ভাষার সাথে পঁচাত্তর উত্তর কবির গদ্য ভাষায় কিছুটা পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। তৃষিত জলধি ও সৌরভের কাছে পরাজিতসহ বেশ কিছু গল্পের অবয়ব দেয়া হয়েছে সাধারণভাবে কম্যুনিকেটিভ গদ্য দিয়ে। সাধারণ ভাষা দিয়ে অসাধারণ কিছু ফুটিয়ে তোলার প্রয়াস লক্ষ্য করা যায় এসব গল্পে, যেটি আমরা আবুল মনসুর আহমদের গল্পগুলোতে দেখতে পাই।

যেভাবে বেড়ে উঠি যখন কবি লিখছিলেন তখন পত্রিকাটির সাহিত্য সম্পাদক সাজ্জাদ হোসাইন খানের এক ধরনের তাড়ার মধ্য দিয়ে আল মাহমুদ এর পর্বগুলো লিখেন। পত্রিকাটির একজন জুনিয়র সংবাদকর্মী হিসাবে তার নৈমিত্তিক লেখা ও ভাবনার পরিবেশ অবলোকন করার পর সেটি যখন পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ হতে থাকে তা পড়ে বেশ বিস্ময়ের সৃষ্টি হতো। আর পুরো বইটি ওবায়েদ ভাই ও বুলবুল সরওয়ারের সাথে অঙ্গীকার প্রকাশনী থেকে যখন প্রকাশের জন্য নতুন করে পড়া শুরু করি তখন এটিকে অসাধারণ এক সৃষ্টি মনে হয়। এটি নিয়ে আলোচনা সমালোচনাও কম হয়নি। কেউ কেউ ভেবেছেন, এটি যদি কবির আত্মজীবনী হবে তবে তা জীবনী বর্ণনার মতো না হয়ে উপন্যাসের মতো কেন মনে হবে? শেষ পর্যন্ত বইটি চিহ্নিত হয় আত্মজৈবনিক উপন্যাস হিসাবে।

যেভাবে বেড়ে উঠি প্রকাশের পরও কবির সাথে এক যুগের বেশি সময় ঘনিষ্ঠভাবে পার করার সুযোগ ঘটে। এ সময়টাতে অন্যান্য দৈনিক ও সাময়িকীর পাশাপাশি অঙ্গীকার, নতুন ঢাকা ডাইজেন্ট, পালাবদল ও অঙ্গীকার ডাইজেস্টে কবির লেখা নিয়মিত বের হতো। এর অনেকগুলোতে কবির লেখা সংগ্রহের দায়িত্ব ছিল আমার উপর। আর পাক্ষিক পালাবদলের উপদেষ্টা সম্পাদক হিসাবে আল মাহমুদের নাম ছাপা হলেও তিনি ছিলেন পত্রিকাটির কার্যত সম্পাদক। দুয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া পত্রিকার প্রতিটি সম্পাদকীয় ছিল আল মাহমুদের লেখা। একই সাথে তিনি লিখতেন সুবৃহৎ উপন্যাস কাবিলের বোন, ডাহুকি, যে পারো ভুলিয়ে দাও অথবা মরু মুষিকের উপত্যকার পর্বগুলো। কবির সম্পাদকীয়ের ভাষা, বক্তব্য ও আবেদন আর সাহিত্য রচনার ধরন ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন।

কবিতার পাশাপাশি কথাসাহিত্যে আল মাহমুদের আবির্ভাব এদেশের গদ্যসাহিত্যের অভিযাত্রায় এক যুগান্তকারী ঘটনা। তিনি যখন গল্প-কাঠামো নির্মাণ করেন, তখন যেন খুব সাবধানে তৈরি করেন বাংলাদেশের বুক। আল মাহমুদ গল্প লিখেছেন ধীরে-সুস্থে; খ্যাতি ও প্রশংসার আকর্ষণ তাঁকে টলাতে পারেনি। তাঁর গল্প-পরিকল্পনায় ও পরিবেশনশৈলীতে রয়েছে নিবিড়চিন্তার ছাপ। প্রখ্যাত কথাশিল্পী আবু রুশদ মন্তব্য করেছেন: ‘বাংলাদেশে আল মাহমুদের সমতুল্য অন্য কোনো কবির হাত থেকে এত কয়টা ভালো গল্প বেরিয়েছে বলে আমার জানা নেই। এটা তাঁর সাহিত্যিক গুরুত্বে ঈর্ষণীয় মাত্রা যোগ করবে বলে আমার বিশ্বাস।’ (প্রেক্ষণ, খন্দকার আবদুল মোমেন সম্পাদিত, আল মাহমুদ সংখ্যা, জুলাই-ডিসেম্বর ২০০৭, ১৫০)

কথাশিল্পী আবু রুশদের ব্যাপারে আল মাহমুদও অনেক উচ্চ ধারণা পোষণ করতেন। পাক্ষিক পালাবদলের উপদেষ্টা সম্পাদক হিসাবে আল মাহমুদের পরামর্শে আমরা সৈয়দ আলী আহসান ও আবু রুশদের কলাম নিয়মিত প্রকাশ করতাম। আবু রূশদ তখন অনেকটাই নিবৃতচারি হয়ে গিয়েছিলেন। তোপখানা রোড়ের একেবারেই কাছাকাছি একটি বাড়িতে থাকতেন। অনেক বড় জায়গা জুড়ে পাচিল ঘেরা ভিটিতে একটি সুন্দর টিন সেড ঘরে তিনি থাকতেন। বিচিত্র ধরনের গাছ আর পাখ পাখালির কলকাকলি ভরা এই বাড়িতে গেলে মনেই হতো না সচিবালয়ের কয়েকশ গজের মধ্যে এমন এক গ্রামিণ পরিবেশ থাকতে পারে, যেটাকে একেবারে অজ পাড়াগাঁ মনে হতো। আবু রুশদের এই বাড়িতে তখন মাঝে মধ্যে শওকত ওসমানকেও পাওয়া যেতো। এই দুজন স্বনামধন্য কথাশিল্পীর মধ্যে সম্পর্কে সম্ভবত অন্য রকম হৃদ্যতা ছিল। এ সময় পালাবদলের লেখার জন্য কবি শাকিল রিয়াজ ও মিলন ইসলামও মাঝে মাঝে যেতেন। পরে পালাবদলের এই দায়িত্ব অর্পিত হয় হুমায়ুন সাদেক চৌধুরির (এখন মরহুম) উপর।

মানুষ-জীবন-প্রত্যাশা-প্রাপ্তি ছিল আল মাহমুদের গল্পের মূল ক্যানভাস। নারী, তার রূপের বর্ণনা, প্রকৃতির সাথে নারীর তুলনা, পরিবার ও সমাজে নারীর অবস্থান এবং নিয়তির অমোঘতা তাঁর গল্পের কেন্দ্রবিন্দু। ‘পানকৌড়ির রক্ত’ গল্পে চিত্রিত হয়েছে আল মাহমুদের গভীর গ্রামপ্রীতি। গল্পকথক গল্পটির প্রারম্ভেই প্রকৃতির বিচিত্র রঙ আর শোভার সাথে ভালোলাগার মানুষকে মিলিয়ে অনুভব করেন। পানকৌড়ির আভরণ-সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হন তিনি; মনে পড়ে যায় সদ্য পরিণীতা স্ত্রীর মুখ-আদল। রোদে গায়ের পানি শুকাতে-থাকা পানকৌড়ির মাঝে তিনি যেন কেবলই দেখতে পান চুল-শুকাতে-থাকা স্ত্রী নাদিরার কোমল মুখ। গল্পকার ভালোবাসেন দেশকে আর প্রিয় মানুষকে। তাই দেশের, প্রকৃতির নির্মলতায় বারবার খুঁজে ফেরেন প্রিয়তমার প্রতিচ্ছবি।

চার.
আল মাহমুদকে আজকের এই দিনে পরম করুণাময় দুনিয়ায় পাঠিয়েছিলেন। এই মহান ব্যক্তিত্বের একটি অধ্যায়ে আমরা কজন তরুণ বেশ গভীরভাবে জড়িয়ে ছিলাম। আশির দশকের শুরুর দিকের এই তরুণ ত্রয়ীর একজন ড. আ জ ম ওবায়েদ উল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি থেকে অবসর নিয়ে এখন সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চা ও পৃষ্টপোষকতার দায়িত্ব পালন করছেন, আরেকজন বিভিন্ন চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ে অধ্যাপনার পর এখন নির্বাক হয়ে গৃহবন্দী । প্রায় শতাধিক বই লেখার পর বুলবুল সরওয়ার যেদিন গাজী সালাউদ্দিনের উপর একটি মহাউপন্যাস লেখা শুরু করার কথা সেদিন গ্রামীণ হেলথের অফিসেই স্ট্রোকের শিকার হন। এরপর বেশ ক’বছর চলে গেল, নিশ্চল কবি আর অনুভবের প্রকাশ ঘটাতে পারেন না কলমে। এই আমিও সাংবাদিকতার স্বাভাবিক চাকরি থেকে অবসর নিয়ে নতুন একটি অধ্যায় শুরুর ভাবনার মধ্যে আছি।

কবি আল মাহমুদের সাথে আমাদের দুই দশকের সক্রিয় সান্নিধ্য সময়ে বাংলাদেশের ইতিহাসের নানা বাঁক জড়িয়ে আছে। আমরা সবাই কবির অসাধারণ কবিতার অনুরাগি। তবে তার কথা সাহিত্যের অনন্য সৃষ্টিকে বহমান রাখার জন্য নানাভাবে চেষ্টা করেছি, উসকে দিয়েছি। আবু রুশদ বা আকতারুজ্জামান ইলিয়াস আল মাহমুদের অনন্য গদ্যশক্তির কথা আগেই বলেছেন। এখন দুই বাংলার অনেক সাহিত্য সমালোচক আল মাহমুদের গদ্য সাহিত্যের নতুন করে মূল্যায়ন করতে শুরু করেছেন। তার সাংবাদিক জীবনের উপর অবশ্য ততটা গভীর মূল্যায়ন হয়নি।

মাসুম খলিলী, সাংবাদিক ও কলামিস্ট, নির্বাহী সম্পাদক দৈনিক নয়া দিগন্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *