আরব আমিরাতের মুক্তো আহরণের ইতিবৃত্ত

অর্থনীতি মধ্যপ্রাচ্য সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

নিজাম উদ্দীন সালেহ সূত্র: গালফ্ নিউজ

তেল আবিষ্কারের আগে বিশ্বের সবচেয়ে বিত্তশালী অঞ্চল সমূহের অন্যতম উপসাগরীয় অঞলের ঐশ্বর্যপূর্ণ দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতের লোকজনকে মুক্তো আহরণের ওপর নির্ভর করতে হতো। সমুদ্র থেকে মুক্তো আহরণ দেশটির ঐতিহ্যের অংশ।

বহু আমিরাতি পরিবার অতীতে তাদের পূর্ব পুরুষেরা যে মুক্তো আহরণ পেশার সাথে জড়িত ছিলেন, তা এখনো স্মরণ করেন। এদের অনেকের বর্তমান অর্থবিত্তের ভিত্তি রচিত হয়েছে মুক্তো ব্যবসার মধ্যে দিয়ে। যদিও বর্তমান সময়ে প্রাকৃতিক মুক্তোর জন্য সমুদ্রে ডাইভ দেয়া তেমন আবশ্যক নয় এবং এগুলো এখন ‘কালচার’ অর্থাৎ কৃত্রিম উপায়ে জন্মানো যায়, তবুও আমিরাতের অনেক বাসিন্দা তাদের পূর্ব পুরুষের ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন। সমুদ্র থেকে মুক্তো আহরণকে তাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক দায়িত্ব বলে মনে করেন। এদের একজন হচ্ছেন আল সুদাইদি।

আল সুদাইদি (৪৫) বলেন, আমি আমার পিতামহের সাহচর্য্যে বড়ো হয়েছি। তিনি আমাকে ‘পার্ল ডাইভিং’ অর্থাৎ সমুদ্র থেকে মুক্ত আহরণের ব্যাপারে অনেক বিষয় শিখিয়েছেন। আমিরাতের ‘সুয়াইদি পার্লস্’ হচ্ছে একমাত্র বাণিজ্যিক মুক্তোর খামার। বর্তমানে বাজপাখি প্রতিপালন ও প্রশিক্ষণ, উটের দৌড় ইত্যাদি ঐতিহ্যবাহী কর্মকান্ডের মতো সামুদ্রিক মুক্তো আহরণের প্রতি মানুষের আগ্রহ বেড়েছে।

গত মাসে আবুধাবীতে বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন মুক্তো পাওয়ার বিষয়টি প্রকাশিত হয়। এটা সংযুক্ত আরব আমিরাতের জনগণের সাথে সমুদ্রের গভীর সম্পর্কের বিষয়টি সবাইকে স্মরণ করিয়ে দেয়। এই প্রাচীন মুক্তো প্রথম বারের মতো আবুধাবীর লুভর মিউজিয়ামে প্রদর্শিত হয়। ৮ হাজার বছরের প্রাচীন একটি মুক্তো প্রমাণ করে যে আমিরাতের সমুদ্র সৈকত জুড়ে সেই নিওলিথিক সময় থেকে মুক্তোর বাণিজ্য চলে আসছে।

লুভর আবুধাবীর ডিপার্টমেন্ট অব কালচার এন্ড ট্যুরিজম-এর প্রতœতাত্তি¡ক শাখার প্রধান পিটার ম্যাগি বলেন, সংযুক্ত আরব আমিরাতের ইতিহাসে বিশাল অধ্যায় জুড়ে মুক্তো আহরণ ছিলো প্রধান অর্থনৈতিক কর্মকান্ড। ১৫ শতক থেকে পরবর্তী সময়ে আমিরাতের প্রাকৃতিক সামুদ্রিক মুক্তো ইউরোপ ও এশিয়া জুড়ে মহামূল্যবান সংগ্রহ বা সম্পদ হিসেবে পরিগণিত হয়। এক সময় সংযুক্ত আরব আমিরাতের মুক্তো শিল্প দেশটির অর্থনীতিতে অতীব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকলেও পরবর্তী সময়ে বিশেষভাবে বিগত তিরিশের দশকে জাপানের কালচার করা অর্থাৎ কৃত্রিমভাবে উৎপাদিত মুক্তোর উদ্ভব ও বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ-সংঘাত মুক্তোকে অতি দামী বিলাস সামগ্রীতে পরিণত করে।

উল্লেখ্য, আল সুয়াইদির মুক্তো খামার তার নিজের শহর আল রামসে অবস্থিত। আল রামস্ উত্তরাঞ্চলীয় আমিরাত রাস আল-খায়মাহের একটি শহর। এটা সমুদ্র উপকূলে উটের চারণভূমি ও জলাবনের তীরবর্তী একটি শহর। সুয়াইদির মুক্তোর খামারের খাঁচাসমূহের ভেতরে ঝিনুকের চাষ হয়। সমুদ্রের তীরে একটি ভাসমান বয়ার সাথে এগুলো বাঁধা থাকে। ১০০টি ঝিনুকের মধ্যে ৬০টি ঝিনুকে মুক্তো উৎপাদিত হয়। আল-সুয়াইদি যখন বালক ছিলেন তখন তিনি তার পিতামহের সাথে সমুদ্র্রে ডাইভ বা ঝাঁপ দিতেন। বর্তমানে মুক্তোর জন্য কেউ সমুদ্রে ডাইভ দেয় না। শুধু আল সুয়াইদির মতো কিছু লোক এখনো এর ভালোবাসা থেকে এটা করে থাকেন।

অনেকে পর্যটকদের দেখানোর জন্য তারা এটা করে থাকেন। সামুদ্রিক মুক্তো আহরণের উদ্দেশ্যে সমুদ্রে ডাইভের জন্য ডাইভার তার এক পায়ের সাথে একটি পাথর বেঁধে নেন, যাতে দ্রæত পানির তলদেশে যাওয়া যায়। এছাড়া দেহের সাথে আরেকটি দড়ি থাকে, যার শেষপ্রান্ত থাকে তার সহকর্মীর হাতে। এভাবে সমুদ্রের তলেদেশে যাওয়ার পর সেখান থেকে ঝিনুক কুড়িয়ে পিঠে ঝুলানো একটি ঝুড়িতে রাখেন। ঝিনুক কুড়ানো শেষ হলে ডাইভার বা আহরণকারী দড়িতে টান দেন। তার সহকারী তখন তাকে টেনে ওপরে তুলেন।

মুক্তোর আকার, আকৃতি ও রংয়ের ওপর এর মূল্য নির্ভর করে। মুক্তো শ্বেত, ক্রিম, ধূসর, হলুদ, নীল ইত্যাদি বর্ণের হয়ে থাকে। এগুলো ২শ’ দিরহাম থেকে ৫০ হাজার দিরহাম অর্থাৎ ১৩ হাজার ৬শ’ ১২ মার্কিন ডলার বা প্রায় ১১ লাখ টাকার মধ্যে হয়ে থাকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *