‘আয়নাঘরে’ বন্দিজীবনের নির্মম কাহিনী জানালেন ব্যারিস্টার আরমান

বাংলাদেশ সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

স্বৈরাচারি হাসিনার আমলে গুম হওয়া বিরোধী দল ও মতের মানুষদের টর্চার সেল ‘আয়নাঘর’ পৃথিবীর কুখ্যাত কারাগার সমূহের চেয় ভয়াবহ বলে বর্ণনা পাওয়া যাচ্ছে। দীর্ঘ আট বছর পর গোপন বন্দিশালা ‘আয়নাঘর’ থেকে ফিরেছেন জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলীর ছেলে ব্যারিস্টার মীর আহমাদ বিন কাসেম (আরমান)। ২০১৬ সালে তাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর থেকে তিনি নিখোঁজ ছিলেন। হাসিনা সরকারের পতনের পর ছাড়া পেয়েছেন।

ব্যারিস্টার আরমানের ভয়াবহ বন্দীজীবনের নির্মম কাহিনী প্রকাশ করেছে লুক্সেমবার্গভিত্তিক বার্তা সংস্থা এএফপি। এতে বলা হয়েছে, বন্দিজীবনের নির্মম কাহিনী ও মুক্তি লাভের ঘটনা। বন্দি থাকা অবস্থায় আট বছরের মধ্যে তিনি কোনোরকম প্রাকৃতিক আলো বাতাসের ছোঁয়া পাননি। কারাগারে কারোর সঙ্গে যোগাযোগ করার কোনো উপায় ছিল না। দীর্ঘ আট বছর একটি কক্ষে তাকে আটক রাখা হয়েছিল। কারাগারের বিষয়ে যেন কেউ কোনো তথ্য না পায় সেজন্য গোয়েন্দারা কঠোর নীতি অনুসরণ করতেন।

গোপন কারাগার থেকে চোখ বেঁধে হাতকড়া লাগিয়ে ব্যারিস্টার আরমানকে মুক্তি দেওয়া হয়। বের হওয়ার সময় গুলির আওয়াজ শুনে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন আরমান। তাকে এমনভাবে বের করা হয়েছিল যেন শ্বাস রোধ হয়ে মারা যাচ্ছিলেন। পরে তিনি টের পান যে তাকে কর্দমাক্ত একটি ময়লা খাদে ফেলে দেওয়া হয়েছে। তখনো তিনি ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনার দেশত্যাগের বিষয়ে জানতে পারেননি। ফলে মুক্তি পাওয়ার বিষয়টিও তখনো বুঝতে পারেননি ব্যারিস্টার আরমান।

ব্যারিস্টার আরমানকে যখন মুক্তি দেওয়া হয় তখন তিনি ভাবেন, তাকে হয়তো হত্যা করা হবে। কেননা তাকে হাত ও চোখ বেঁধে নিয়ে আসার মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগেই শেখ হাসিনার পতনের বিষয়টি তার অজানা ছিল। গত ৫ আগস্ট গণআন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নেন শেখ হাসিনা। এ দিনও আয়নাঘরের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বন্দি ছিলেন আরমান।

ব্যারিস্টার আরমান জানান, কারাগার থেকে তিনি বাইরের আজানের ধ্বনি শুনতে পেতেন। সেখানে জোরে জোরে গান বাজানো হতো। আজানের শব্দ শুনে কেবল দিন রাতের পার্থক্য করতেন তিনি। কতদিন কারাগারে অতিবাহিত করেছেন সে বিষয়ে তার কোনো ধারণা ছিল না। কারাগারে গান বন্ধ হলেই তিনি অন্য বন্দিদের চিৎকার শুনতেন। ফলে ধীরে ধীরে তিনি বুঝতে পারেন যে সেখানে তিনি একা নন। সম্ভবত সেখানে নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে বন্দিরা চিৎকার করত।

২০২২ সালে একটি গণমাধ্যমে আয়নাঘর সম্পর্কে খবর প্রকাশিত হওয়ার আগ পর্যন্ত ওই গোপন কারাগার সম্পর্কে মানুষের কোনো ধারণাই ছিল না। যদিও বিগত সরকারের সময় বলা হয়েছিল, যারা নিখোঁজ হয়েছেন তারা অবৈধ উপায়ে ইউরোপে পারি দিতে গিয়ে ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে প্রাণ হারিয়েছেন।

ব্যারিস্টার আরমানের বাবা জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলী। সরকার তার বিরুদ্ধে মানবতা বিরোধী মামলা করলে আরমান তার বাবার বিচারিক কার্যক্রমে আইনি লড়াই করতে লন্ডন থেকে ঢাকায় গিয়েছিলেন। তখন তার বয়স ছিল ৩২ বছর। সে সময় ট্রইব্যুনালের বিভিন্ন পদ্ধতিগত ত্রুটি এবং বিচারিক পক্ষপাতের বিষয়ে গণমাধ্যম এবং বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার রিপোর্টে উঠে আসে। ২০১৬ সালে এক রাতে সাদা পোশাকধারী কয়েকজন বাড়িতে প্রবেশ করে তাকে তুলে নিয়ে যায়। তাকে সিঁড়ি দিয়ে টেনেহিঁচড়ে নামিয়ে গাড়িতে তোলা হয়। তাকে তুলে নেওয়ার চার সপ্তাহ পর মীর কাসেম আলীর ফাঁসি কার্যকর করা হয়।

ব্যারিস্টার আরমান জানান, তাকে ফেলে যাওয়ার পর তিনি বাড়ির পথ খোঁজার চেষ্টা করছিলেন। পরে তিনি তার বাবার প্রতিষ্ঠিত একটি হাসপাতালের খোঁজ পান এবং সেখানে গিয়ে তিনি তার পরিচয় দেন। হাসপাতালটির এক কর্মকর্তা তার পরিচয় শনাক্ত করতে পেরে তার পরিবারের সাথে যোগাযোগ করেন। এ সময় তিনি হাসপাতালে উপস্থিত লোকজনের কথা শুনে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ছাত্র আন্দোলনের কথা জানতে পারে। এ আন্দোলনের ফলে তিনি মুক্তি পেয়েছেন।

আরমান বলেন, দেশের তরুণদের জন্য আমি মুক্তি পেয়েছি। আমি যখন এই তরুণদের দেখি যে তারা দেশকে নেতৃত্ব দিচ্ছে, তখন আমি বাংলাদেশের সঠিক গন্তব্য সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *