আমির আজিজ ও গণকণ্ঠের বাণীভাষ্য । মুসা আল হাফিজ

প্রবন্ধ-কলাম সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

‘রাস্তায় হাঁটতে বের হলাম গতকাল। সাথে নিলাম এক কাপ চা, পান করব বলে। তখনো সুরুজ উঠেনি, আসমানে রয়ে গেছে চাঁদ। ঘুমভেজা তন্দ্রায় ঢুলু ঢুলু তারকারাজি। আমার গান রয়ে গেল চায়ের পেয়ালায়।’ এ হচ্ছে একটি গীতিকবিতা শুরুর বক্তব্য, যার লেখক আমির আজিজ। গীতিটির নাম ‘অচ্ছে দিন ব্লুজ’। ভারতে ক্ষমতাসীন দলের আচ্ছা দিন (শুভ দিন, ভালো দিন) প্রচারণার ডামাডোলে এই কবিতা সামনে আসে। যেখানে কবি সমসাময়িক বাস্তবতার জটিল চেহারা অঙ্কন করেছেন। কবি জানাচ্ছেন, ফজরের সময় পেরিয়ে গেল। আজান হলো না। জানতে চাইলাম ঘটনা কী? মসজিদ কি বন্ধ হয়ে গেল? সাকি বলল- ভেঙে গেছে মসজিদ, হয় না নামাজ। যদিও ইবাদতের লোক এখনো বেঁচে আছে অনেকেই। বাতাস ছিল শীতল। সুন্দর মৌসুম। কিন্তু পাশেই ছিল ছোট এক শিশু ভীষণ ব্যথিত। চিন্তাকাতর। কবি এই পরিস্থিতির জটিলতায় যখন বিক্ষত, তখন সাকি বলল, এখানেই পড়ে থাকলে তো হবে না। আরেক দৃশ্য তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। চলো-

কবি জানাচ্ছেন, তার পরের পরিস্থিতি দেখব বলে চললাম; এক পাগল কুত্তা, ঠিকানাহীন। মন একেবারে খারাপ না। সুন্দর সকাল। হাঁটতে হাঁটতে গেলাম দোকানে। খুবই ভিড় ছিল চারধারে। জানতে চাইলাম কী বিক্রি হচ্ছে দোকানে? না আছে ডাল, না চিনি, না লবণ। দোকানদার বলল, একবার তো প্রশ্ন করেছ, সাবধান করে দিচ্ছি দ্বিতীয়বার আর প্রশ্ন করো না। আমার কাছে বিক্রি করার কিছুই নেই। ফলে বিক্রি করছি অবহেলা। ডালের দাম বেড়ে গেছে খুব। তাই বিক্রি করছি ঘৃণা। কবি খুব আহত হলেন। কিন্তু দোকানদার বলল, আরো সামনে যাও তুমি। তোমার জন্য অপেক্ষা করছে আরো দৃশ্য।

এরপর দেখা যায়, আলোয় ভরা গমগমে সকাল। চারদিকে সরব ব্যস্ততা। এক মৃত জলাশয়ে এক জীবিত মাছের নড়াচড়া। সড়কের কিনারায় পড়ে আছে হাজারো ইজ্জত ও আব্রু (বাস্তুহীন নর-নারী)। একটু পরেই লাখ লাখ মানুষ পরিচয়পত্র নিয়ে সারিবদ্ধ হতে থাকল। চোখে তাদের ভয়। দূর থেকে তখন একটি আওয়াজ ভেসে আসছিল ‘ভারত মাতা কি জয়’।

বিশ্ববিদ্যালয়ের এক উপাচার্য তাকে বললেন, সামনে যাও। তোমার জন্য অপেক্ষা করছে চিত্রাবলি। বিকেল হয়ে গেছে তখন। বৃষ্টি ঝরছে। আকাশ গর্জাচ্ছে। মব লিঞ্চিংয়ের উত্তেজনা চলছে এর মধ্যে। এক গাছের ডালে ঝুলে আছে মৃত মানুষ। লোকেরা স্লোগান দিচ্ছে- হত্যাকারী কত মহান! গোটা পরিস্থিতির মাথায় বসে হাসিমুখে এক রাজা সবাইকে শুনাচ্ছেন- শুভ দিন আসছে।

একটি আঞ্চলিক পরাশক্তি হিসেবে ভারতের উত্থান যখন আগের তুলনায় অনেক বেশি মাত্রায় দৃশ্যমান, তখন আচ্ছে দিনের প্রচারণা চালাবে ভারত সরকার, এটি স্বাভাবিক। কিন্তু এর ভেতরে যেসব দগদগে ক্ষত রয়েছে, তার প্রতি দৃষ্টি না দিলে স্বপ্নযাত্রা মরীচিকায় হারিয়ে যেতে পারে। ফলে যে বাস্তবতাকে শাসক শ্রেণী আড়াল করতে চায়, তাকে সামনে আনার কাজ করবেন বুদ্ধিজীবী, কবি। আমির আজিজ এ কাব্যে কাজটি এত প্রাজ্ঞ সাবলীলতায় করলেন যে, লোকেরা মুগ্ধ বিস্ময়ে জানতে চাইল- কে এই কবি?

এই কবির জন্ম ১৯৯০ সালে বিহারে। পাটনার এক দরিদ্র গ্রামে দরিদ্র পরিবারে জন্ম ও বেড়ে ওঠা। ২০০৬ সালে জামেয়া মিল্লিয়া দিল্লিতে যখন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হন, ততক্ষণে পরিচিতরা তাকে জানেন সাংস্কৃতিক কর্মী হিসেবে। ২০১৯ সালের প্রথম প্রহরে ইউটিউবে তিনি প্রকাশ করেন এ গীতি। সুর ও কণ্ঠ দেন নিজেই। প্রথম আত্মপ্রকাশেই অসাম্য, বঞ্চনা, জাতিবিদ্বেষ, নিপীড়ন ও কলুষিত রাজনীতির একেবারে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেলেন আমির। এরপর একে একে প্রকাশিত হলো তার বারুদগন্ধী বিভিন্ন কবিতা, গান।

২০১৯ সালের ১১ ডিসেম্বর ভারতীয় পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ লোকসভায় পাস হয় ভারতের সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন। যাতে ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব দেয়া-না দেয়ার প্রসঙ্গটি ছিল। যার ফলে লাখ লাখ মানুষ স্টেটলেস হওয়ার আশঙ্কায় পতিত হয়। এ আইন নিয়ে ভারতে ব্যাপক বিতর্ক ও আন্দোলন হয়। এ আন্দোলনে অন্তত ৮৩ জন মানুষের মৃত্যু হয়। আহত ও কারারুদ্ধের সংখ্যা হাজার হাজার। এ সময় গণমানুষের আন্দোলনের ভাষা নির্মাণ করে আজিজের কবিতা। তিনি লিখেন- ‘সব ইয়াদ রাকহা জায়েগা’ কবিতা। এতে আমির লিখেন- ‘তোমরা লেখো কালোরাত, আমরা লিখব চাঁদ।’ ‘তোমরা আদালতে বসে তামাশা লেখবে, সংগ্রামের পথে ও দেয়ালে আমরা লিখব ইনসাফ’, ‘বলব এত জোরে, শুনবে বধিরও/লিখব এত স্পষ্ট, পড়তে পারবে অন্ধজন।’ ‘তোমরা জমিনে জুলুম লিখো/ আকাশ লাল করে লেখা হবে ইনকিলাব।’

এ কবিতায় আমির বলেন সেসব মানুষের কথা, ‘যাদের সঙ্কল্প ভাঙতে পারেনি লোহার হাতকড়া’, ‘যাদের বিবেক কিনতে পারেনি ইজারাদারের কড়ি’, ‘যারা দাঁড়িয়ে ছিল নূহের প্লাবন হওয়ার পরও’, ‘নিজের মৃত্যুসংবাদের পরও বেঁচে ছিল যারা।’ অত্যাচারীদের তিনি শুনিয়ে দেন, ‘যখনই জগতে কাপুরুষতার কথা উঠবে, তোমার অপকর্মের কথা মনে রাখা হবে/যখনই জগৎ বলবে, জীবন কার নাম, তখন আমাদেরকে মনে রাখা হবে।’ দিনে মিষ্টি বুলির প্রতারণা আর রাত হলে লাঠি ও গুলি, প্রতিবাদীদের ওপর হামলা করে তাদেরকে হামলাকারী বলা, হত্যা, ঘরে ঢুকে সর্বস্ব বিনাশ ইত্যাদির বিবরণ দিয়ে আজিজ বলেন- ‘এসব ঘটনা লিখে রাখব আমি আমার হাড়ে।’

জামেয়া মিল্লিয়ায় বসে কবিতাটি লিখেন আজিজ। পোস্ট করেন সামাজিক মাধ্যমে। মুহূর্তেই জামেয়া ও জওয়াহেরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস মুখর করে তোলে। স্ফুলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়ে দিল্লির রাজপথে। সেখান থেকে দাউ দাউ করতে করতে চলে যায় শাহিনবাগে। সারা দেশে। বাংলাসহ নানা ভাষায় অনূদিত হতে থাকল কবিতাটি। আজিজের ফোকনির্ভর গান সাহিত্যে নোবেলজয়ী বব ডিলান এবং সঙ্গীতশিল্পী জনি ক্যাশের দ্বারা অনুপ্রাণিত। তবে অনেকেই তার কবিতা ও গানে দেখেন পিঙ্ক ফ্লয়েডের ওয়েটিং ফর দ্য ওয়ার্মসের দূরবর্তী আত্মীয়তা। ১৯৭৯ সালে বর্ণবৈষম্য, সাম্রাজ্যবাদ ও উগ্র জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে এ গান লিখিত হয়।

তারপর ‘পিঙ্ক ফ্লয়েড’ এর ‘দ্য পাইপারস অ্যাট দ্য গেটস অব ডন’ (১৯৬৭) থেকে নিয়ে ‘দ্য ওয়াল’ (১৯৭৯), ‘দ্য ফাইনাল কাট’ (১৯৮৩), ‘দ্য ডিভিশন বেল’ (১৯৯৪), ‘দ্য অ্যান্ডলেস রিভার’ (২০১৪) পর্যন্ত রক গানগুলো ঝড় তুলেছে। কিংবদন্তি হয়ে উঠেছেন সিড ব্যারেট, নিক মেসন, রজার ওয়াটার্স, রিচার্ড রাইটদের মতো ব্যক্তিত্বরা। ‘পিঙ্ক ফ্লয়েড’ ব্যান্ডের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা রজার ওয়াটার্স আজিজের কবিতাটিকে নিয়ে গেলেন লন্ডনের পার্লামেন্ট স্কোয়ারে।

২০২০ এর ২৭ ফেব্রæয়ারি এক প্রতিবাদ মঞ্চে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের মুক্তির দাবি করছিলেন রজার। সেখানে আমির আজিজের কবিতাটির ইংরাজি অনুবাদ পাঠ করেন তিনি। বলেন, এই তরুণের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল।

ঠিকই বলেছিলেন রজার। আজিজ নিজেকে এরপর অব্যাহত উজ্জ্বলতার সাথে হাজির করেছেন। গুজরাট দাঙ্গায় যে বিলকিস বানুকে দলবদ্ধ ধর্ষণ ও তার পরিবারের সাত সদস্যকে হত্যা করা হয়, তার নামে আজিজ লিখেন বিলকিস- এ সঙ, ২০১৭ সালে গরু পরিবহনের অভিযোগে নিহত পিলু খানের নামে তিনি লেখেন বাল্লাদ অব পিলু খান, গণ-অধিকার পদদলিত করার জবরদস্তির বিরুদ্ধে লিখেন, ‘ম্যায় ইনকার করতা হো।’ এসব কবিতা ও গান প্রতিবাদ, নান্দনিকতা, সৌন্দর্য, বিদ্রুপ, রূপকতা, আবেদন ও পরিস্থিতির অন্তরে প্রবেশের অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতায় শুধু সময়ের প্রতিবেদন হয়ে ওঠেনি; বরং হয়ে উঠেছে সেই অনস্বীকার্য শিল্পদ্রোহ, যার আবেদনের আলিঙ্গনে চলে আসে গোটা ভারতের নিপীড়িত গণকণ্ঠের বাণীভাষ্য। কবি ভুলে গেছেন গুলি ও মৃত্যুর ভয়। ফলে তিনি বলেন, তোমরা চাইলেই গুলি করতে পারো আমাদের। কিন্তু আমাদের গুলি করলে আমরা মরে যাবো, তা তো নয়। মরতে অবশ্য আমাদেরও ভয় হয়। কিন্তু এই ভয়ে আমরা ডরাতে থাকব, এমন নয়।

এমন সাহসিকতা নিয়ে মজলুম মানুষের পক্ষ থেকে একজন আজিজ বলতে পারেন, ৭ ঘণ্টার এক সংসদ অধিবেশন আমার প্রাণের ফয়সালা করবে, আমি তা মানি না। আমার দেশে আমাকে অধিকারের বদলে ভিক্ষা দেয়া হবে, আমি তা মানি না। আমাকে নিছক এক নামের মতো কোনো রেজিস্টারে লিখে রাখা হবে, আমি তা মানি না। জখমকে ফুল বলব, আমি তা মানি না। জালিমকে রাসূল বলব, আমি তা মানি না। কার্ফুকে গণতন্ত্র বলব, আমি তা মানি না। মিথ্যাকে সত্য বলে, এমন জবানের প্রতিটি নড়াচড়া আমি প্রত্যাখ্যান করি।

লেখক : কবি, গবেষক
71.alhafij@gmail.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *