আমার দুটি অনুবাদ ও আমেরিকার বই বাজার ।। আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু

শিল্প-সংস্কৃতি সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

“আই অ্যাম নট অ্যান আইল্যান্ড”

গতবছর ‘মাতৃভাষা প্রকাশ’ আমার অনুবাদ করা ভারতের খ্যাতিমান সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও চলচ্চিত্র পরিচালক খাজা আহমদ আব্বাসের আত্মজীবনী “আই অ্যাম নট অ্যান আইল্যান্ড” প্রকাশ করেছে। ৫৭৫ পৃষ্ঠার বই, মুদ্রিত মূল্য ১,২০০ টাকা। এক বছরে ৫০ কপি বই বিক্রয় হয়নি।

এ আত্মজীবনী উপমহাদেশে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, সাহিত্য, সাংবাদিকতা ও চলচ্চিত্রের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। কিন্তু খাজা আহমদ আব্বাসকে চেনার বা তাকে জানার কোনো প্রয়োজন কি বাঙালি পাঠকের আছে? নেই।

কিন্তু আমি খাজা আহমদ আব্বাস এবং তার সমসমায়িক কৃষণ চন্দর, সাদাত হাসান মান্টো, ইসমত চুগতাই, তাদের সিনিয়র মুনশি প্রেম চান্দ ও মুলক রাজ আনন্দ, জুনিয়র এম. কে নারায়ননের ছোটগল্প পড়ে বেড়ে উঠেছি।

অতএব, খাজা আহমদ আহমদ আব্বাস আমার আবেগের সঙ্গে জড়িত এবং তার আত্মজীবনী অনুবাদে আমার সময় ও শ্রমকে অর্থহীন বিবেচনা করি না। কিন্তু প্রকাশক অর্থ বিনিয়োগ করেছেন, তার বিনিয়োগ উঠে আসা উচিত।

“টু হিস্টোরিক ট্রায়াল ইন রেড ফোর্ট”

নেতাজি সুভাষ বোসের গড়া “ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি” বা “আজাদ হিন্দ ফৌজ” এর কথাই বা কতটুকু মনে রেখেছে বাঙালি। তিনি উপমহাদেশের সকল ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মাঝে যে সম্প্রীতি গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন, সেই দৃষ্টান্ত আর কোনো নেতা রাখতে পারেননি।

কিন্তু জাপান আজাদ হিন্দ ফৌজকে সহায়তা করার পরিবর্তে সিঙ্গাপুর, বার্মা ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ভারত থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিলে আজাদ হিন্দ ফৌজকে ব্রিটিশ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে হয়।

এ বাহিনীর তিন অফিসার মেজর জেনারেল শাহনওয়াজ খান, ক্যাপ্টেন প্রেম সেগাল ও ক্যাপ্টেন গুরবখশ সিং ধীলনের কোর্ট মার্শাল হয়।

বিচারের বিবরণী ইতিহাসের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দলিল। এটির বাংলা অনুবাদ করি। ২০২০ সালে ১,২০০ টাকা মূল্যের ৭১২ পৃষ্ঠার এই বইটি প্রকাশ করেছে ‘নালন্দা’। এটিও দুর্ভাগ্যের কবলে পড়েছে। চার বছরে ৫০ কপিও বিক্রি হয়নি।

আমি কি গুরুত্বপূর্ণ বই অনুবাদ করা বর্জন করবো? নিজেকেই প্রশ্ন করি। আমার ভালো লাগা বই বাংলা পাঠে স্বচ্ছন্দ পাঠকের কাছে পৌছে দেওয়া আমার দায়িত্ব বলে মনে করতাম। ভাবতাম, জাতির মহা উপকার করছি। আমার নিজের বিশ্বাসের প্রাচীরে ফাটল ধরেছে।

তবে আমেরিকায় প্রকাশিত অধিকাংশ বই বিক্রয়ের পরিসংখ্যান দেখে মনে হলো, ভালো বইও নানা কারণে বিক্রয় হয় না। বাঙালি পাঠককে দোষ দিয়ে কি হবে?

আমেরিকায় বহু বই ১২টির বেশি বিক্রি হয়নি

প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান বড় হলেই যে পাঠকরা তাদের প্রকাশিত সব বই লাইন ধরে কিনবেন, এর কোনো গ্যারান্টি নেই। ২০২১ সালের হিসাব অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রে নামিদামি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিবছর কমবেশি ৫৮ হাজার শিরোনামের বই প্রকাশ করে। এগুলো মধ্যে মাত্র ১০% শিরোনামের বই বহু বছরে বা বইগুলোর পুরো জীবনে ২ হাজার কপি বিক্রি করে করতে পারে।

এগুলোর মধ্যে অন্তত অর্ধেক বই মাত্র অর্ধ ডজন বিক্রয় হওয়ার রেকর্ডও আছে। প্রকাশনা সংস্থার বাইরে যেসব লেখক ব্যক্তিগত উদ্যোগে অথবা ধরা যাক, আমাজনের মতো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বই প্রকাশ করেন, তাদের মধ্যে অনেক খ্যাতিমান লেখকের ভালো বইও প্রথম বছরে মাত্র ২০০ কপি এবং পনের/বিশ বছরে ১ হাজার কপির বেশি বিক্রয় হয়নি।

অর্থ্যাৎ তারা বই প্রকাশের খরচও তুলতে পারেননি। এমনকি বড় প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানেও অনেক বই আছে, যেগুলো বহু বছরে ১২ কপির কম বিক্রয় হয়েছে।

‘বার্নস এন্ড নোবল’ বার্ষিক গড়ে ১০ লাখ শিরোনামের ১৯ কোটি বই অনলাইনে ও তাদের স্টোর ও এজেন্টের মাধ্যমে বিক্রয় করে। অর্থ্যাৎ তারা প্রতিটি শিরোনামের বই গড়ে ১৯০ কপি করে বিক্রি করে। কোনো কোনোটি বেশি বিক্রি হয়, কোনো কোনোটি একেবারেই কম।

তবে অবাক হওয়ার ব্যাপার হলো কোনো কোনো শিরোনামের বই সারা বছরে সম্ভবত মাত্র ১ কপি বা ২ কপি বিক্রয় হয়েছে।

আমেরিকার বড় প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো স্বীকার করে যে, তারা তাদের প্রকাশিত বইয়ের মার্কেটিং করতে কোনো অর্থ ব্যয় করে না, অথবা খুব সামান্য ব্যয় করে। ২০২১ সালে ‘র‌্যান্ডি পেঙ্গুইন’ ২.৭ বিলিয়ন ডলারের বই বিক্রয় করেছে।

কিন্তু মার্কেটিং এর জন্য ব্যয় করেছে মোট বিক্রয়ের মাত্র ২%, অর্থ্যাৎ প্রায় ৫৫ মিলিয়ন ডলার। এটাও সরাসরি মার্কেটিং এর জন্য নয়, শীর্ষস্থানীয় লেখকদের পেছনে, তাদের বই প্রকাশ উপলক্ষে অনুষ্ঠান আয়োজন করতে। ছোট লেখকরা সেই সুযোগও পান না।

যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছর প্রকাশক ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রকাশিত গ্রন্থের (গড়ে ৫৮,০০০ শিরোনাম) মধ্যে মাত্র ০.৪% বা মাত্র ১৬৩টি শিরোনামের বই গড়ে ১ লাখ কপি বা এর বেশি কপি বিক্রয় হয়েছে।

০.৭% বা ৩২০টি শিরোনামের বই ৫০ হাজার কপি থেকে ১ লাখ কপি; ২.২% বা ১,০১৫টি শিরোনামের বই ২০ হাজার কপি থেকে ৫০ হাজার কপি; ২.৪% বা ১,৫৭২টি শিরোনামের বই ১০ হাজার কপি থেকে ২০ হাজার কপি; ৫.৫% বা ২,৫১৮টি শিরোনামের বই ৫ হাজার কপি থেকে ১০ হাজার কপি; ২১.৬% বা ৯,৮৬৩টি শিরোনামের বই ১ হাজার কপি থেকে ৫ হাজার কপি; ৫২.৪% বা ২৩,৪১৯টি শিরোনামের বই মাত্র ১২ কপি থেকে ১ হাজার কপি; এবং ১৪.৭% বা ৬,৭০১টি শিরোনামের বই ১২টির কম কপি বিক্রয় হয়েছে।

এই পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রতি বছর আমেরিকায় যত শিরোনামের বই প্রকাশিত হয়, তার অর্ধেকের বেশি ১ হাজার কপির কম বিক্রয় হয়।

* আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু উপদেষ্টা সম্পাদক- উইকলি বাংলাদেশ, নিউ ইয়র্ক। সাবেক সম্পাদক- মাসিক নতুন ঢাকা ডাইজেস্ট।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *