আমাকে ক্ষমা করো প্রভু ।। আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু

ভ্রমণ-স্মৃতিকথা সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

কনফারেন্স প্যালেস, জেদ্দা ১৩ অক্টোবর, ১৯৯০

আমার জেদ্দা সফরের আমন্ত্রণ আকস্মিক ছিল। তিনদিন আগে বিকেলে অফিসে এসে শুনলাম, কুয়েত দূতাবাস থেকে আমার পাসপোর্ট চেয়ে পাঠানো হয়েছে। একজনের হাতে পাসপোর্ট পাঠিয়ে দিয়ে সৌদি দূতাবাসের জনসংযোগ কর্মকর্তা শাহ আবদুল হালিমকে ফোন করলাম। তিনি জানালেন, জেদ্দায় কুয়েতিদের একটি কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হচ্ছে, আমাকে সেখানে অ্যাটেন্ড করতে হবে। ঢাকার আরো দু’জন সাংবাদিক আমার সফরসঙ্গী হবেন — বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) নিউজ এডিটর মোফাখখারুল আনাম ও দ্য নিউ নেশনের ডিপ্লোমেটিক করেসপন্ডেন্ট মতিউর রহমান। জেদ্দার উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করার আগে ঢাকাস্থ কুয়েতি রাষ্ট্রদূত আমাদের ব্রিফ করবেন।

পরশু গিয়েছিলাম কুয়েতি রাষ্ট্রদূত মি: নাজরানের গুলশানের বাসভবনে। আমি সেখানে পৌছার পর একসঙ্গে এলেন আনাম ভাই ও মতি ভাই। রাষ্ট্রদূত নিজেও কনফারেন্স সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানেন না। তার কাছে শুধু একটি টেলেক্স বার্তা এসেছে, ১২ অক্টোবরের মধ্যে ঢাকা থেকে তিনজন সাংবাদিককে জেদ্দায় পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে। প্রবাসী কুয়েত সরকার তাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করবে। তিন দিনব্যাপী কনফারেন্স কভার করতে আরো অনেক বিদেশি সাংবাদিক আসবেন বলে মি. নাজরান আমাদের জানালেন।

পূন্যভূমি সৌদি আরবে আসার সুযোগ এমন সহসাই হবে, তেমন ধারণা করিনি। সেই শৈশব থেকে আরব দেশ, ধূঁ ধূঁ মরুভূমি, উটের কাফিলা, খেজুর গাছ, মক্কা-মদিনার কথা শুনে এসেছি। পবিত্র কা’বা শরীফ, মহানবী সা: এর রওজা মোবারক, মসজিদে নববীর ছবি এঁকেছি মনের পটে। আমার দাদা হজ্ব করতে এসেছিলেন, সম্ভবত আমার জন্মের পর এবং আমার স্মৃতির ধারণ ক্ষমতা সৃষ্টির আগে। তিনি কা’বা শরীফ তাওয়াফ করেছেন, মিনায় শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ করেছেন, আরাফাতের ময়দানে হজ্ব সমাবেশে অংশগ্রহণ করেছেন, মদিনায় নবীজির রওজা মোবারক জিয়ারত করেছেন। জ্ঞান হতেই আমি দেখেছি, আমার দাদা গ্রামের একমাত্র ‘হাজী সাব’।

দাদা হজ্ব সমাপান্তে দেশে ফেরার সময় তার দেওয়া কোরবানির উটের গোশতের খানিকটা শুকিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেই গোশত বাঁশের শলায় ঢুকিয়ে টিনের চালের সঙ্গে আটকে রেখেছিলেন আমার দাদি। বাড়িতে যেদিন উটের গোশতের শুটকি রান্না হতো, আমরা চূলার পাশে বসে অখণ্ড মনোযোগে সেই পবিত্র বস্তুর রান্না দেখতাম। দাদির ট্রাংকের মধ্যে একটি বয়েমে রাখা ছিল জমজম কূয়ার পবিত্র পানি। প্রাকৃতিক নিয়মে সেই দুর্লভ পানি কমে গেলে দাদি আমাদের পাত কূয়ার পানি ঢেলে বয়েমে জমজমের পানির সমতা বজায় রাখতেন। তাছাড়া দাদা মক্কা থেকে জমজমের পানিতে তার কাফনের যে কাপড়গুলো ধুঁয়ে এনেছিলেন, সেগুলোও সযত্নে রক্ষিত ছিল ট্রাংকে। পবিত্র পানি বিধৌত কাফনের কাপড় যাতে নষ্ট না হয়, সেজন্যে মাঝে মাঝে সেগুলো বের করে রোদে দেওয়া হতো। অবশ্য আমার দাদা সেই কাফন পরে কবরে যেতে পানেনি। হজ্ব পালন করার প্রায় দুই দশক পর আমার দাদা কোথায় হারিয়ে যান। তার আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। যে কাফনে আচ্ছাদিত হয়ে দাদার কবরস্থ হওয়ার কথা, দাদির মৃত্যুর পর তাকে সেটি পরিয়ে দাফন করা হয়। যাহোক, এসব থেকে মক্কা-মদিনা এবং হজ্ব পালন করতে এসে জিয়ারতের অন্যান্য ঐতিহাসিক পবিত্র স্থানগুলো সম্পর্কে একটি ধারণা মনের মাঝে গাঁথা হয়ে গিয়েছিল।

স্কুলের নিচের দিকের ক্লাসে মহানবী সা: এর ওপর কাহিনি পড়ে কুরাইশ বংশ, আরববাসীদের প্রকৃতি সম্পর্কে জানতে পারি। ধর্ম সম্পর্কে আমার নিজের জানার আগ্রহের কারণে নবী-রাসুল এবং ইসলামের বিভিন্ন দিকের ওপর জানার সুযোগ হয়। এই ধারাবাহিকতায় অন্যান্য মুসলমানের মতো আমার মনেও আল্লাহর ঘরের একটি ছবি স্থায়ীভাবে অঙ্কিত হয়ে যায়। সৌদি আরবে এসে আল্লাহর সেই ঘর তাওয়াফ করতে পারবো — এই আশা আমার বুকে আবেগের ঝড় তোলে।

গতরাতেই জেদ্দা এসে পৌছেছি। মতি ভাই এবং আমার থাকার জায়গা ঠিক হয়েছে হায়াত রিজেন্সি হোটেলে। আনাম ভাইয়ের জন্যেও বুকিং দিয়েছি আমরা। কিন্তু তিনি আমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন। রিয়াদের কিং খালিদ ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস পরীক্ষার সময় আনাম ভাই দাঁড়িয়েছিলেন লাইনের সামনের দিকে। তার পাসপোর্টে এন্ট্রি সিলমোহর লাগানোর পর তিনি ইমিগ্রেশনের বেষ্টনি পেরিয়ে আমাদের জন্যে কিছু সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন। আমাদের বিলম্ব হবে দেখে তিনি ওপার থেকে হাত তুলে বোঝালেন, টার্মিনালের কোণার দিকে আমাদের জন্যে অপেক্ষা করবেন।

আনাম ভাই ইতিপূর্বে বেশ ক’বার সৌদি আরব সফর করেছেন। এইতো, গত মাসেও তিনি ঘুরে গেলেন সৌদি সীমান্তে আমেরিকান ফোর্স ডেপ্লয়মেন্ট দেখে। আমরা নিশ্চিত, অভিজ্ঞতা তাকে ভুল পথে নিয়ে যাবে না। কিন্তু পরে দেখা গেল, আনাম ভাই যেদিকে গেছেন, আমাদের লাইনের অবশিষ্ট লোকগুলোর পার্সপোর্টে সিলমোহর লাগিয়ে তার বিপরীত দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বা এয়ারপোর্টের সৌদি কর্মীরা দিক নির্দেশনা দিয়ে সেদিকে যেতে বলছেন। সৌদি আরবে কর্মরত এক বাংলাদেশি আমাদের বললেন, জেদ্দাগামী কানেকটিং ফ্লাইট ধরতে হলে এদিকেই যেতে হবে। আপনাদের বন্ধু ভুল করেছেন। তবুও আমাদের মনে হলো, আনাম ভাই অবশ্যই ফ্লাইট ধরে ফেলবেন।

এয়ারপোর্টের তিন তলায় আমরা জেদ্দার কানেকটিং ফ্লাট ধরার জন্যে ডেপারচার লাউঞ্জে এসে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, রিয়াদ-জেদ্দা ফ্লাইট নিয়মিত। আনাম ভাইয়ের জেদ্দা পৌছতে কোনো অসুবিধা হবে না। একটি ফ্লাইট মিস করলে অনায়াসে পরের ফ্লাইট ধরতে পারবেন। তা সত্ত্বেও মতি ভাই তন্ন তন্ন করে খুঁজলেন আনাম ভাইকে। এয়ারপোর্ট ও এয়ারলাইন কর্মকর্তাদের যারা ইংরেজি বুঝতে পারেন তাদের কাছে সমস্যাটি বললেন। কিন্তু আনাম ভাইকে পাওয়া গেল না। বিমানেও উঠার পর মতি ভাই বিমানের এ মাথা থেকে শেষ মাথা পর্যন্ত খুঁজলেন। আনাম ভাই বিমানেও উঠেননি। দু:শ্চিন্তা মাথায় নিয়ে রাত এগারোটার দিকে জেদ্দার কিং আবদুল আজিজ ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে পৌছলাম।

অ্যারাইভ্যাল গেটে তিনজন কুয়েতি আমাদের স্বাগত জানালেন। আমরা তাদেরকে আমাদের তৃতীয় সফরসঙ্গী আনাম ভাইয়ের কথা বললাম। তারা আমাদের আশ্বস্ত করলেন যে, জেদ্দা পর্যন্ত টিকেট এবং ঢাকা থেকে ইস্যু করা কুয়েতি কর্তৃপক্ষের কাগজপত্র দেখালেই সৌদিরা তাকে সহায়তা করবে। তারা আমাদের গাড়ি তুলে হায়াত রিজেন্সিতে নিয়ে এলেন। কিন্ত রাতে আনাম ভাই এলেন না।

আজ সকালে লোহিত সাগরের তীরে অবস্থিত কনফারেন্স প্যালেসে কুয়েতিদের তিন দিনব্যাপী কনফারেন্স উদ্বোধন করলেন কুয়েতের আমি শেখ জাবের আহমদ আল-সাবাহ। সুসজ্জিত সম্মেলন কক্ষে কুয়েতের জাতীয় সঙ্গীত বাজানোর সময় প্রবাসী কুয়েতিরা ঘন ঘন চোখ মুছছিল। মঞ্চ আমাদের অবস্থান থেকে খানিকটা দূরে। তবুও মনে হলো সদা আনত মুখ আমিরের চোখে অশ্রু। ইরাকিরা তাদের মাতৃভূমি দখল করে নিয়েছে। গত আগস্টে ইরাকি বাহিনী রাতের অন্ধকারে আমির শাসিত ক্ষুদ্র এই ভূখন্ডটি দখল করার পর এই প্রথম এত বিপুল সংখ্যক কুয়েতি তাদের দেশকে মুক্ত করার বিষয়ে আলোচনা করতে মিলিত হয়েছেন জেদ্দায়।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের নিউজ ফোনে ঢাকায় পাঠিয়ে লবিতে চা পান করার সময় হঠাৎ চোখে পড়ল, আনাম ভাই চায়ের কাপ হাতে চামচ দিয়ে চিনি নাড়ছেন। দৌড়ে তার কাছে গেলাম।
আনাম ভাই বললেন, সে এক লম্বা কাহিনি। রিয়াদ এয়ারপোর্টে তিনি যে গেট দিয়ে বের হয়েছেন সেটি যেসব যাত্রী রিয়াদে রয়ে যাবে তাদের জন্যে। বের হয়েই নিজের ভুল বুঝতে পারেন আনাম ভাই। এটা হতেই পারে। ভুল শোধরানো জন্যে তাকে কেউ সহযোগিতা করবে না, এটাই বরং অস্বাভাবিক। গাঁটের আশি ডলার ব্যয় করে রিয়াদ-জেদ্দা টিকেট কিনে জেদ্দায় পৌছেন রাত একটায়।

এয়ারপোর্টে তাকেও কুয়েতিরা রিসিভ করে কনফারেন্স প্যালেসের পাশেই সুবিশাল কমপ্লেক্স জামজুম সেন্টারে নিয়ে যায়। এই সেন্টারে খাবার ব্যবস্থা নেই। আনাম হায়াতে নিয়ে এলাম।

মক্কা ১৬ অক্টোবর, ১৯৯০

জেদ্দায় এসেই যোগাযোগ করেছিলাম পাটোয়ারীর সঙ্গে। আবদুল মোনাফ পাটোয়ারী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সহপাঠি। ভালো ছাত্র ছিলেন। শিক্ষাজীবন শেষ করে কিছুদিন কলেজে শিক্ষকতা করেছেন। পরে সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন। ধর্ম মন্ত্রণালয়ে সহকারী সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করার সময় মক্কায় বাংলাদেশের স্থায়ী হজ্ব মিশনে নিয়োগ দিয়ে তাকে পাঠানো হয়েছে। ইতোমধ্যে এখানে তার দু’বছর কেটেছে। পাটোয়ারীর সঙ্গে কথা বলে ঠিক করেছিলাম, ১৬ অক্টোবর আমরা তার সঙ্গে ওমরাহ পালন করতে মক্কায় যাবো। তিনি খুশি হলেন। তিনি পরিবার নিয়ে মক্কায় বসবাস করেন। প্রতিদিন জেদ্দায় যান অফিস করতে। জেদ্দার বাংলাদেশ কনস্যুলেটেই স্থায়ী হজ্ব অফিস।

এর মাঝে একদিন পাটোয়ারী এসে আমাদের নিয়ে গিয়েছিলেন জেদ্দাস্থ বাংলাদেশ কনস্যুলেটে। জেদ্দার কনসাল জেনারেল সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী। তার সঙ্গে ও হজ্ব মিশনের প্রধানের সঙ্গে পৃথক পৃথক আলোচনা করে সৌদি সমাজ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে সামান্য ধারণা লাভ করলাম। বহু বিবাহ সৌদি সমাজের অন্যতম বৈশিষ্ট। এক স্ত্রী নিয়ে সংসার করছে এমন সৌদি পুরুষ পাওয়া মুশকিল। অধিকাংশ ক্ষেত্রে কন্যার বিয়েতে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে বৃদ্ধ পিতা তার কন্যার বয়সী আরেকটি মেয়েকে বিয়ে করে। কয়েকটি সন্তান জন্ম দেওয়ার পর সেই স্ত্রী যখন আর তরুণী থাকে না, তখন তাকে তালাক দিয়ে ও তার সকল প্রাপ্য বুঝিয়ে আরেকটি তরুণীকে বিয়ে করে। এভাবে বিয়ে ও তালাকের অব্যাহত প্রক্রিয়ার মধ্যে আর্থিকভাবে সমর্থ অধিকাংশ সৌদি পুরুষ ইসলামের বিধান লঙ্ঘনের জন্যে অভিযুক্ত হওয়া থেকে নিজেকে এড়াতে চার স্ত্রীর সমতা বজায় রাখে। মহিলাদের দাবিয়ে রাখার সকল প্রকার প্রক্রিয়া অবলম্বন করে ইসলামের মোহর লাগিয়ে নেয়।

পাটোয়ারী ও হজ্ব মিশন প্রধান জনাব নূরুজ্জামান তাদের অভিজ্ঞতা থেকে আরো জানান যে, এর ভিন্ন চিত্রও রয়েছে। যেসব সৌদি তরুণের আর্থিক সামর্থ নেই, অর্থ্যাৎ বিয়ে করার জন্য কোনো কন্যার পিতাকে যৌতুক প্রদানের সামর্থ নেই, তারা যথাসময়ে বিয়ে করতে পারে না। সম্প্রতি সৌদি সরকার ব্যাংকের মাধ্যমে তাদের জন্যে ঋণ কর্মসূচি চালু করেছে, যাতে তারা যৌবন ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই যৌতুক পরিশোধ করে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে। তাদের কথায় বিস্মিত হই। বলতে গেলে সমগ্র আরব জগতে এ রীতি প্রচলিত। বিয়ে করতে চাইলে কন্যার পিতাকে অর্থ দিতে হবে এবং এই অর্থে কন্যার কোনো অধিকার নেই। এ সম্পর্কে ইসলামের বিধান আমি জানি না। বলতে দ্বিধা নেই, ইসলাম সম্পর্কে আমার জ্ঞান যৎকিঞ্চিত। যেহেতু আরববাসী মুসলমানদের এ রীতি অনৈসলামী বলে প্রতিবাদ করেছেন বা করছেন বলে আমার জানা নেই, অতএব ধরেই নিচ্ছি যে, পাত্র কর্তৃক পাত্রীর পিতাকে অর্থ পরিশোধ করে বিয়ে করার বিধান ইসলাম সম্মত।

শুধু তাই নয়, পাটোয়ারী আরো মজার কথা বললেন, হজ্ব অফিসার হিসেবে তাকে মোয়াল্লেমদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে হয়, যাদের মাধ্যমে মূলত হাজীরা হজ্ব সমাপন করেন। বিভিন্ন দেশ থেকে মোয়াল্লেমদের হজ্বযাত্রী নিয়ে আসা বর্তমান সময়ের আদম ব্যবসার মতোই। তারা এজন্য হজ্বযাত্রীদের কাছে ফি আদায় করেন, যা তাদের বিরাট আয়। অধিকাংশ মোয়াল্লেম হজ্ব মওসুম শেষে তাদের মুনাফার অর্থ যৌতুকে ব্যয় করে কোনো পিতার কাছ থেকে তার কন্যাকে শয্যাসঙ্গিনী করার জন্যে বিয়ে করেন।

ইসলামী বিধান অনুসারে আহলে কিতাব, অর্থ্যাৎ বিভিন্ন পর্যায়ে আল্লাহ প্রেরিত ধর্মগ্রন্থে বিশ্বাসী, অর্থ্যাৎ ইহুদি ও খ্রিস্টান মেয়েদের ধর্মান্তরিত না করেই স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করা সম্ভব হলেও ইসলামের সৌদি ব্যাখ্যা ভিন্নতর। বিদেশি কোনো ‘জবরদস্ত’ আলেম অথবা ‘ইহলোক ও পরলোকের সকল বিষয় সম্পর্কে জ্ঞাত’ ইসলামী চিন্তাবিদের পক্ষেও কোনো সৌদি রমণীকে শরিয়াহসম্মতভাবে বিয়ে করা সম্ভব হয়েছে, এমন দৃষ্টান্ত নেই। যেকোনো দেশের মুসলমান ইউরোপ, আমেরিকায় গিয়ে শ্বেতাঙ্গিনী বিয়ে করছে এমন ঘটনা অহরহ। কিন্তু বহিরাগত কোনো মুসলিম কোনো সৌদি পরিবারে বিয়ে করেছে, এমন ঘটনা কেউ জানে না। ইসলামে নাকি আরব আজমে, আশরাফ আতরাফে কোনো ভেদাভেদ নেই, তাহলে সৌদিদের বিয়ে সংক্রান্ত বিষয়টির ব্যাখ্যা কি?

জেদ্দা কনস্যুলেটের লেবার অ্যাটাশে জানালেন তার কাছে বাংলাদেশি শ্রমিকদের নিয়ে আসা অভিযোগের প্রসঙ্গ। বেদুইনদের পশুপালক হিসেবে যারা চাকুরি নিয়ে এসেছে, মাসের পর মাস তাদের বেতন আটকে রেখেছে বেদুইনরা। শ্রমিকদের সঙ্গে বেদুইনদের সমকামে লিপ্ত হওয়ার এবং বেদুইন পুরুষের অনুপস্থিতির সুযোগে তাদের পরিবারের নারীরা শ্রমিকদের দিয়ে তাদের যৌনক্ষুধা মিটিয়ে নেওয়ার অভিযোগও আসে তার কাছে। মহিলারা নাকি এত বেপরোয়া যে তাদের কথায় রাজি না হলে উল্টো শ্রমিকের বিরুদ্ধে ‘জিনা’র অভিযোগ আনার হুমকি দেয়। জিনা’র ক্ষেত্রে যেহেতু একমাত্র শাস্তি শিরোচ্ছেদ, অতএব, জীবনের মায়ায় বেদুইন নারীদের সঙ্গে সঙ্গমে লিপ্ত না হয়ে তাদের উপায় থাকে না। কিন্তু তাদের শরীরেই বা কত কুলায়। মানুষের যৌন ক্ষমতারও তো সীমাবদ্ধতা থাকে। পূন্য দেশে আসার আগে কারো যদি এসব জানা থাকত, তাহলেও না হয় মকরধ্বজ ধরনের যৌনশক্তি বর্ধক দাওয়াই সঙ্গে নিয়ে আসতে পারত। এসব শুনি, আর বিস্ময়ে হা করে থাকি।

কনফারেন্স শেষ হওয়ার আগে সাক্ষাৎ হলো মোস্তফা ওসমানের সঙ্গে। দুবাই ভিত্তিক দৈনিক সংবাদপত্র ‘গালফ নিউজ’ এর আবুধাবি ব্যুরো চিফ। সাত বছর আগে ১৯৮৩ সালে পশ্টিম বার্লিনে আমরা তিন মাস একসঙ্গে কাটিয়েছি একটি প্রশিক্ষণ কোর্সে। মোস্তফা ওসমান সুদানের নাগরিক হলেও সাংবাদিকতা জীবনের অধিকাংশ সময় গালফ নিউজে কাটিয়েছেন। আমরা গাঢ় আলিঙ্গনে আবদ্ধ হলাম। বিভিন্ন দেশের তেরো জন সাংবাদিক বার্লিনের ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিটিউট ফর জার্নালিজমের সেই কোর্সে ছিলাম।

১৫ অক্টোবর কনফারেন্স শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু শেষ হলো আজ দুপুরে। সমাপনী অনুষ্ঠানে এক কিশোরী একটি আরবি কবিতা আবৃত্তি করল। দেশাত্মবোধক কবিতা। উপস্থিত প্রতিটি কুয়েতি আবৃত্তি শুনতে শুনতে কান্নায় ভেঙে পড়ল। সফেদ আলখেল্লার প্রান্ত তুলে তারা ঘন ঘন চোখ মুছছিল। কুয়েতি প্রধানমন্ত্রী শেখ সা’দ আল-সাবাহ’র প্রেস কনফারেন্সের রিপোর্ট ঢাকায় পাঠিয়ে হোটেলে ফিরতে বিলম্ব হলো।

পাটোয়ারী অপেক্ষা করছিলেন হোটেলের লবিতে। আমাদের মক্কায় নিয়ে যাওয়ার জন্যে তিনি হজ্ব মিশনের গাড়ি নিয়ে এসেছেন। ইহরাম বাঁধতে সহায়তা করলেন পাটোয়ারী। দুই খণ্ড সাদা কাপড়ে আচ্ছাদিত হলাম। ইহরাম কোনো পোশাক নয়। আচ্ছাদন। শুধু শরীর ঢেকে রাখার জন্যে। ইহরাম বাঁধার একটি আধ্যাত্মিক মর্ম রয়েছে। নিজেকে পৃথিবীর মায়া মমতা, লোভ-লালসা থেকে বিমুক্ত করা। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে নিজেকে সমর্পণ করা। নতুন রূপে আবির্ভূত হওয়ার আশায় মৃতদের কাতারে শামিল হওয়ার জন্যে প্রস্তুতি নেয়া।

কিন্তু আমি কি মরতে চাই? মায়াময় সংসার, আমার পরিচিত পরিমণ্ডল, আমার প্রতিপত্তি, আমার শৈশব, সোনালি কৈশোর — সবই তো আমাকে পিছু টানে। আমি তো পরকালের অনন্ত জীবন, বেহেশতের অনাবিল সুখের বর্ণনার প্রতি বিশ্বাস এনেছি প্রতিষ্ঠিত সত্য মেনে নেয়ার ধারাবাহিকতায়। তবুও কেন সেই অদৃশ্য সুখ-সাচ্ছন্দ্যের হাতছানির চেয়ে পৃথিবীর এই সংক্ষিপ্ত জীবনের মোহ কাটিয়ে উঠতে পারছি না? মৃত্যুকে কেন আমার এত ভয়? আমি কি আসলে অবিশ্বাসী? যা কিছু দেখছি, ভোগ করছি, তার অন্তরালের কোনোকিছু কি আমি স্বীকার করি না? হয়তো করি, হয়তো করি না। আমি বোধ হয় দোদুল্যমানতায় ভুগছি। হয়তো আমার মাঝে পরকালের কঠোর শাস্তির ভয়। মৃত্যুর পরই তো পৃথিবীতে কৃত পাপের শাস্তি প্রতি পর্যায়ে অপেক্ষা করছে আমার জন্যে। জেনে বুঝে কত যে পাপ করেছি, সব তো আমারই স্মরণে নেই। অজান্তেও কতশত পাপ করে পাপের পাল্লা ভারি করেছি। কিন্তু আমার কাঁধের দুই ফেরেশতা ‘কিরামান-কাতিবিন’ তো খুটিনাটি সব ধারণ করে রেখেছে। কি করে তা থেকে নিস্তার লাভ করব আমি?

আমার মৃত্যু মানে তো আমার কৃত পাপের জন্যে আজাবের শুরু। অতএব আমার মতো পাপিষ্ঠ নিজেকে আল্লাহর কাছে সমর্পণ করতে চাইলেই কেন তিনি আমাকে গ্রহণ করবেন? তার আরাধনা করার জন্যে এই বিশাল বিশ্বজুড়ে কত সৎ-সদাশয়, পূন্যবান মানুষ আছেন। আমার ইবাদত, আমার কান্না তাঁকে আবৃষ্ট করবে না। কি করে তাঁর কাছে আামার সকল দুর্বলতা, পর্বত প্রমাণ পাপকে লুকিয়ে রাখব?

পাটোয়ারী আমাদের ওমরাহ করবেন বলে তিনিও ইহরাম বাঁধলেন। হোটেল থেকে বের হয়ে বাংলাদেশ হজ্ব মিশনের মাইক্রোবাসে উঠলাম। উচ্চকণ্ঠে পাঠ করলাম, “লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক। লাব্বায়েক লা শারীকা লাকা লাব্বায়েক। ইন্নাল হামদা, ওয়া নিয়া’মাতা লাকা ওয়াল মুলক। লা শারীকা লাক!”

“প্রভু, আমি উপস্থিত। তোমার কোনো অংশীদার, প্রভু, আমি তোমার অনুগ্রহের প্রশংসা করছি —!”

হাইওয়ে ধরে বাস মক্কার পথে ছুটে চলেছে। আমরা যাচ্ছি মহান সৃষ্টিকর্তার নৈকট্য লাভের জন্যে। মাঝে মাঝে পাটোয়ারী পথিপার্শ্বের স্থানগুলোর বর্ণনা দিচ্ছেন। ডানদিকে দেখা যাচ্ছে জেদ্দা বন্দর।

বন্দর এলাকা ছেড়ে একটু অগ্রসর হওয়ার পর বললেন, ‘বামদিকে, ওইখানে আগে দাস কেনাবেচনা হতো – দাস বাজার। দাস মানে তো হযরত বিলাল রা:। আবিসিনিয়া (ইথিওপিয়া) থেকে আমদানি করা কাফ্রি গোলাম। তিনি ক্রীতদাস ছিলেন বলে আল্লাহকে ডাকার অধিকার পর্যন্ত তার ছিল না। বিলালের মুখে আল্লাহর প্রশংসা তাঁর মনিবের গায়ে ধরাতো ক্রোধ ও প্রতিহিংসার আগুন। সে আগুনের দাহ কমতো বিলালকে বেত্রাঘাতে জর্জরিত করে। তাকে ক্ষুধা ও পিপাসায় কাতর রেখে। উত্তপ্ত বালুকার মধ্যে চিৎ করে শুইয়ে বুকে পাথর চাপ দিয়ে।

এই কি সেই স্থান অথবা এমনি এক দাস বাজারেই কি গোলামির জিঞ্জির পরিয়ে আনা হয়েছিল বিলালকে? ইসলামের আবির্ভাব হয়েছিল গোলামির জিঞ্জির ছিন্ন করে ফেলার জন্যে। শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে দাস প্রথা গ্রিক, রোমান ও মিশরীয় সাম্রাজ্যকে কতভাবেই না বিকশিত করেছিল। এসব সাম্রাজ্যের প্রতিটি অট্টালিকার পাথর, প্রতিটি স্তম্ভ, প্রতিটি কীর্তির আস্তরের সঙ্গে মিশে আসে দাসদের ঘাম, রক্ত এবং নির্মম অত্যাচারে বেরিয়ে যাওয়া প্রাণের হা-হুতাশ। সপ্তম শতাব্দিতে স্পার্টাকাসের নেতৃত্বে দাস বিদ্রোহের পূর্ব পর্যন্ত দাস প্রথা যেমন ছিল, পরবর্তীতে তা আরো কঠোর, আরো অমানবিক হয়েছে। অভিজাতদের কাছে পশুর যে গুরুত্ব ছিল, ভাগ্যচক্রে দাসে পরিণত মানুষের তাও ছিল না। পশু নানাভাবে উপকারী। এরা সহজে পোষ মানে। যেমন খুশি কাজে লাগানো যায়। পশুর মাংস, দুধ উপাদেয়। চামড়া, পশম, অস্থিরও ব্যবহার বহুবিধ। অন্যদিকে দাসদের দিয়ে কাজ করানোও শক্ত। চোখে চোখে রাখতে হয়। চাবুকের ঘা না পড়লে নড়তে চায় না। সুযোগ পেলেই চেষ্টা করে জোট বাঁধতে, ছুটে পালাতে।

আমেরিকান ঔপন্যাসিক হাওয়ার্ড ফাস্টের কালজয়ী উপন্যাস ‘স্পার্টাকাস’ এর বর্ণনা অনুসারে ‘রোম এবং দাস এক হয়ে গিয়েছিল। দাস ছাড়া রোমানরা কল্পনাও করতে পারত না। দাসকে বশে রাখার জন্যে তারা অত্যাচারও চালাতো অমানুষিক। যে কাজে পশু ব্যবহার করা যায়, সে কাজে দাসদের নিয়োগ করা লাভজনক মনে করত তারা। তাদের বক্তব্য ছিল, ‘যে পশু চিন্তা করতে পারে না, তাদের চেয়ে যে পশু চিন্তা করতে পারে তারাই অধিক কাম্য’। দাস নির্ভর রোমানরাও ছিল দাস প্রথরাই সৃষ্টি। বিশাল প্রমোদ উদ্যানে বাস করে যে গৃহস্বামী, তাকেও থাকতে হয় হাজার দাসের কৃপায়।” দার্শনিক সিসেরো’র মতো “দাস মাত্রই ‘ইনস্ট্রুমেন্টুম ভোকালে’ – নিছক কথক যন্ত্র।”

সভ্যতার উষালগ্নে যে দাসপ্রথা বিলুপ্ত হওয়ার কথা, ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তি তা টিকিয়ে রেখেছিল আধুনিক যুগ পর্যন্ত। আফ্রিকার কালো মানুষ ও পশুর মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখেনি তারা। এক শতাব্দিকাল আগে আমেরিকায় দাস প্রথা উচ্ছেদ হলেও কালোদের নাগরিক অধিকার স্বীকৃত হয়েছে মাত্র ষাটের দশকে। হযরত বিলালের বংশধররাই কি প্রাণপাত করে গড়ে তোলেনি ইউরোপীয় বা আমেরিকান সভ্যতা? কৃতিত্ব দাসদের, দাসের মনিবদের নয়। কিন্তু ইতিহাস তো তা বলে না। যারা ইতিহাস লেখে, যারা ইতিহাস লেখায়, ইতিহাস তো তাদের। সে কারণেই সভ্যতার প্রতিটি পর্যায়ে দেখা যায়, অবদান ও কৃতিত্ব সবই শাসকের। শ্বেতাঙ্গ ও অশ্বেতাঙ্গ প্রভুদের। কখনোই তা দাসের নয়।

সৌদি আরবে গত দুই বছর অবস্থান করে পাটোয়ারী অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। তিনি বললেন, রাসুলে করিম সা: মক্কা বিজয়ের সময় এই পথ দিয়েই গিয়েছিলেন। মদিনা থেকে এটি ঘোরা পথ। দুশমনকে বিভ্রান্ত করতেই তিনি সোজা পথে মক্কায় প্রবেশ করেননি। পর্বতের বুক চিড়ে প্রশস্ত রাস্ত এগিয়ে গেছে মক্কার দিকে। এ পথ তো এত সুন্দর ছিল না রাসুলের জামানায়। খাড়া পর্বত সারি দুই পাশে। এ পথও পর্বতেরই অংশ ছিল। আমার রাসুল সা:’কে কি মক্কার পথে এসব পর্বতে আরোহণ এবং অবতরণ করতে হয়েছিল? কি দুর্গম পথ! কোথায় পানি, কোথায় ছায়া? এই বিকেলেও পড়ন্ত সূর্যের কিরণে ঝলসে যাচ্ছে পাথুরে পর্বত। যেন আগুন ঠিকরে বের হচ্ছে। কি করে তিনি যুদ্ধ সাজে তাঁর বাহিনী, উটের কাফিলা, ঘোড়া নিয়ে পাড়ি দিয়েছিলেন এই দুর্গম পথ?

শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মাইক্রোবাসে বসে হাইওয়ের দুই পাশের তাপদগ্ধ প্রকৃতি দেখেই আমি পিপাসার্ত। চৌদ্দশো বছর আগে প্রিয় নবী আমাদের জন্যে শান্তি নিশ্চিত করতে কি কষ্টই না করেছেন! তাঁর সীমাহীন কষ্টের বিনিময়ে আমি আজ কি নিরুপদ্রব এক মুসলিম! এই সহজ ধর্মই কি আমি আদৌ পালন করি? আমার মধ্যে কি আল্লাহর ভয় আছে? আমি তো সুখের গড্ডালিকায় গা ভাসিয়ে আমার দিবস-রজনী কাটিয়ে যাচ্ছি।

এই যে ওমরাহ পালন করতে আমি ধাবিত হচ্ছি কা’বার পানে, আসলে কি আমি আমার পাপ স্খালনের জন্যে যাচ্ছি? আমার নিত্যদিনের পাপকর্ম, পাপচিন্তা, আচার-আচরণে আমার মধ্যে ন্যায়নিষ্ঠতার যে অভাব তা কি স্খালনযোগ্য অপরাধ?

রাসুল সা: কেন শুধুমাত্র তার উম্মত হওয়ার সুবাদে আমার পাপমুক্তির জন্যে সুপারিশ করবেন? তার সুপারিশ লাভের কি যোগ্যতা আছে আমার মধ্যে? যার নির্দেশ পালনে আমার এই শৈথিল্য, আমি কীভাবে তার মহানুভবতার স্পর্শ লাভ করব? তাহলে আমি কেন যাচ্ছি পূন্যভূমি মক্কার পানে? আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে দুর্নিবার আশা। কৃত পাপ স্খালনের বাসনা। নতুন করে জীবন শুরুর তীব্র আকাংখা।

হাইওয়ের পাশে কোনো কোনো স্থানে সাজানো গোছানো অট্টালিকার সারি। বৃক্ষহীন নগরীর রুক্ষ শোভা। খুব লোকজন আছে বলে মনে হলো না। অট্টালিকাগুলো নবনির্মিত হলেও মনে হচ্ছে, সবই পরিত্যক্ত। রূপকথার দৈত্যের ভয়ে যেন নগর ছেড়ে পালিয়েছে জনমানব। পাটোয়ারী জানালেন, সৌদি সরকার মরুবাসী যাযাবর বেদুইনদের জন্যে স্থায়ী আবাসিক ব্যবস্থা করেছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। নানা প্রলোভনে আকৃষ্ট করার মাধ্যমে চেষ্টা করেছে তাদের যাযাবর জীবরেন অনিশ্চয়তা ও উচ্ছৃঙ্খলতা ঘোচাতে। কিন্তু সমাজবদ্ধ জীবনের মাঝে তারা খুঁজে পায়নি কোনো আনন্দ বা বেঁচে থাকার মর্ম। কিছুদিন এসব অট্টালিকায় থাকার পর তারা হয়তো একদিন রাতের অন্ধকারে চুপিসারে পালিয়ে গেছে মরুভূমির ধুঁ ধুঁ বালুকারাশির মধ্যে। তাবুর নিচে যাযাবর বেদুইন তার ছাগল, ভেড়ার সঙ্গে ঘুমাতে যত স্বাচ্ছন্দ বোধ করে, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অট্টালিকায় আধুনিক জীবনযাত্রার মধ্যে তার সে স্বাচ্ছন্দ্য আসে না। শহরবাসী সৌদিরা ঠাট্টা করে বলে, বদুরা (বেদুইন) হয়তো এই অট্টালিকাতেও বাস করত, যদি একই সঙ্গে উট ও বকরির ঘুমানোর ব্যবস্থা থাকত।

“লাব্বায়েক, আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক –” উচ্চারণ এবং পার্বত্য শোভা দেখে এগোতে এগোতে সূর্য পর্বতের আড়ালে ঢলে পড়ল। আমরা তখন মক্কা নগরীর উপকণ্ঠে, শহরতলীতে। আমার হৃদয় আলোড়িত হচ্ছে। হৃদপিণ্ডের স্পন্দন হঠাৎ করেই দ্রুততর হয়েছে। রীতিমতো লাফাচ্ছে। অস্থি ও পেশির বন্ধনী ভেদ করে যেন ছিটকে বের হয়ে যাবে অশান্ত হৃদপিণ্ড। এই তো আমি আমার স্বপ্নের নগরীতে উপস্থিত হয়েছি। পাটোয়ারী, আনাম ভাই জোরে জোরে উচ্চারণ করছেন, “লাব্বায়েক, আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক” — আমিও পড়ছি। মতি ভাইয়ের কণ্ঠেও একই সুরের প্রতিধ্বনি।
এই সেই নগরী, যেখানে আমার প্রিয় নবী মুহাম্মদ সা: এর জন্ম। যেখানে কেটেছে তার শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। যে নগরীর অদূরে মেষ চরাতে গেলে ফেরেশতারা তার বুক চিড়ে হৃদপিণ্ড থেকে দূর করেছেন কলুষতা। যে নগরীর অনতিদূরে হেরা পর্বতের গুহায় তিনি পেয়েছিলেন নবুয়ত লাভের সুসংবাদ। আল্লাহর নির্দেশে ফেরেশতা জিবরাইল ধ্যানমগ্ন নবী করিম সা: কে বলেছেন, ‘ইকরা’ –পড়ো। তিনি উত্তর দিয়েছেন, ‘আমি তো পড়তে জানি না।’ জিবরাইল তাকে দু’বার আলিঙ্গন করে একই কথা বলেন এবং রাসুল একই উত্তর দেন। জিবরাইল তৃতীয় দফা তাঁকে দৃঢ় আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে আল্লাহর প্রথম অহি তাঁকে পৌছান:

“ইকরা বিসমি রাব্বিকাল্লাজি খালাক। খালাকাল ইনসানা মিন আলকা। ইকরা ওয়া রাব্বুকা আকরামুল্লাজি আল্লা মা বিল কালাম –।” (পড়ো, তোমার প্রভুর নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। জমাট রক্তের একটি পিণ্ড থেকে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। পড়ো, আর তোমার প্রভু অত্যন্ত অনুগ্রহশীল, যিনি কলমের সাহায্যে জ্ঞানের শিক্ষা দিয়েছেন। মানুষকে এমন জ্ঞান দিয়েছেন, যা তারা জানত না –।)

নবুয়ত প্রাপ্তির পর তিনি মক্কাবাসীদের আহবান জানান সত্য পথে ফিরে আসতে। এই নগরী ধন্য তাঁর পূন্য স্মৃতি ধারণ করে। অথচ এখানে কি নির্মম অত্যাচারে জর্জরিত হতে হয়েছে তাঁকে। বিতাড়িত হতে হয়েছে নগরী থেকে। সবশেষে নিজ নগরীকে বিজয় করতে হয়েছে তাঁকে।

সন্ধ্যা নেমেছে পবিত্র মক্কা নগরীতে। মাগরিবের আযান ধ্বনিত হচ্ছে। পাটোয়ারী বললেন, হারাম শরীফে গিয়ে মাগরিবের জামাত ধরা যাবে না। বাসায় মাগরিব সেরে তাওয়াফ করতে আসাই উত্তম হবে। আরো মাইক্রোবাস মোড় ঘুরে চলল বাংলাদেশ হজ্ব মিশনের মক্কাস্থ অফিস ভবনে। এ অফিসের চারতলায় পাটোয়ারীর বাসা।

হজ্ব মিশন হারাম শরীফের কাছেই। গাড়ি থেকে নেমে পেছন ফিরে তাকাতেই চোখে পড়ল আলোকোজ্জল মিনার। আমার হৃদয়ে একই আবেগের ঝড়। আমি রাসুল সা: এর নগরীতে উপস্থিত হয়েছি। নগরীর যে পথের ওপর আমি দাঁড়িয়ে আছি, প্রিয়নবী কি তার শৈশবে এ পথ দিয়ে মেষপাল তাড়িয়ে নিয়ে যেতেন পর্বতের পাদদেশে? অথবা আমার আশপাশের বাড়িঘরগুলোর কোনোটিতে কি মা আমিনার কোল জুড়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন মহানবী? পাটোয়ারী আমার প্রশ্নের উত্তরে জানিয়েছিলেন রাসুল সা: এর স্মৃতি খুব জাঁকালোভাবে সংরক্ষণ করা হয়নি বিদায়াত হবে আশঙ্কায়। সেজন্যে নগরীর যেখানে নবী করিম জন্মগ্রহণ করেছিলেন, সেই বাড়িটি গুরুত্বহীনভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে। কিন্তু কোন্ পথে তিনি চলাচল করেছেন, কোথায় তাঁর অন্যান্য স্মৃতি তা বিস্তারিত জানার কোনো উপায় নেই।

এই ব্যাখ্যায় নিজেকে আশ্ব্স্ত করতে পারি না। তাওয়াফ, সা’য়ীর সময় অথবা জমজমের পাশে দাঁড়িয়েও তো আমি রাসুল সা:কে নিবিড়ভাবে অনুভব করব। আমি তো ভাববো, আমি যে নিয়ম-রীতিগুলো পালন করছি, একদিন আমার নবী এই স্থানে একইভাবে তা পালন করেছেন। যে পথে দাঁড়িয়েছি, আমার নবীর পবিত্র পদস্পর্শে না জানি কতবার ধন্য হয়েছে এ পথ। অথবা মক্কার জালিম কাফিররা এই পথে নবীজির ওপর কঙ্কর নিক্ষেপের জন্যে ছেলেছোকরাদের লেলিয়ে দিযেছিল। তাঁর দেহ থেকে হয়তো এ পথের শুস্ক মাটিতে ঝরেছিল রক্ত। আমি কি সেখানেই আমার কলুষিত পদযুগল স্থাপন করে দাঁড়িয়েছি? তাহলে তো পাপ আমাকে আরো গ্রাস করবে। সম্ভবত আমার উচিত হয়নি মক্কা নগরীতে প্রবেশ করা। কোন্ অধিকারে নবীর স্মৃতি বিজড়িত এই নগরীর মাটি, বাতাসের স্পর্শ নেব আমি?

আমাদের নিত্যদিনের পাপ স্খালনের আমায় এই নগরীতে যে বিপুল জনসমাগম ঘটে, তাতে তো এখান বাতাস ভারি হয়ে উঠার কথা। তা যে হয় না, তা কি প্রিয় নবীর মাহাত্মের কারণেই?
মাগরিব পড়ে নিলাম পাটোয়ারীর বাসায়। এরপর কা’বা ঘর তাওয়াব করার জন্যে বের হলাম। মিশনের গাড়িতেই পথটুকু গিয়ে আমরা প্রবেশ করলাম মসজিদুল হারামে। এরপর নেমে গেলাম মূল চত্তরে। সুপ্রশস্ত উন্মুক্ত চত্তর। কেন্দ্রস্থলে কালো গিলাফে আচ্ছাদিত চতুস্কোণ আল্লাহর ঘর। যে ঘরের দিকে ফিরে, যে ঘরকে অনুভবে রেখে এতদিন নামাজ আদায় করেছি, সেই পবিত্র ঘর আমার সামনে। হজরে আসওয়াদে চুম্বনের জন্যে প্রতিযোগিতা। কা’বার গিলাফ ধরে অশ্রুপাতের দৃশ্য অভাবিত। এশা নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায়ের পর তাওয়াফ শুরু করলাম। সাতবার কা’বা প্রদক্ষিণ করার পর হজরে আসওয়াদকে চুম্বনের জন্যে আমিও প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হলাম এবং এক সময় প্রাণ ভরে কালো পাথরে চুম্বন করলাম।

তাওয়াফ শেষে সাফা ও মারওয়া পর্বতের মধ্যে দৌড়াদৌড়ি অর্থ্যাৎ সা’য়ী করার জন্যে এগিয়ে গেলাম। অনুচ্চ দুটি পর্বতকে মসজিদুল হারাম কমপ্লেক্সেও মধ্যে অন্তর্ভূক্ত করে আচ্ছাদিত করা হয়েছে। নির্বাসিত বিবি হাজেরা তাঁর সন্তান ইসমাইলকে প্রসবের পর পানির সন্ধানে একবার সাফা, আরেকবার মারওয়া পর্বতে উঠে চারদিকে তাকিয়েছেন কোথাও পানির উৎস আছে কিনা তা দেখতে।

দৌড়ানোর সময় অনতিদূরে অরক্ষিত অবস্থায় ফেলে আসা সদ্য প্রসূত সন্তানের দিকে ফিরে ফিরে তাকিয়েছেন। পানি না পেয়ে অবশেষে ক্লান্ত শ্রান্ত ও হতাশ, উদ্বিগ্ন বিবি হাজেরা যখন সন্তানের পাশে ফিরে এলেন, তখন অবাক বিস্ময়ে দেখলেন, তাঁর সন্তানের পদতলে কাক্সিক্ষত পানির ক্ষীণ ধারা। শিশুর পায়ের মৃদু আন্দোলনেই সিক্ত হয়ে উঠেছে বিশুস্ক বালি। তা থেকে ক্রমে বিকশিত হয়েছে সুপেয় পানির অফুরন্ত উৎস জমজম কূপ।

সা’য়ী শেষে আবে জমজম বা জমজমের পানি পান করার জন্যে গেলাম। আকণ্ঠ পান করলাম পবিত্র পানি। আঁজলা ভরে পানি নিয়ে সারা দেহ সিক্ত করলাম। তাওয়াফ সাা’য়ী শেষে আমার শরীরে পবিত্র অনুভূতির অনরনন হচ্ছে। পাপবোধ, মনের ক্লেদ-কালিমা যেন দূর হয়েছে। জমজম থেকে আবার কা’বার সামনে এলাম। আমরা স্থির করলাম, কাল সকালে মক্কা নগরী ছেড়ে যাওয়ার আগে আবারও কা’বা ঘর তাওয়াফ করব। এরপর আর কখনো প্রিয়নবীর জন্মভূমিতে ফিরে আসা হবে কিনা, জানি না। সেজন্যে কা’বার সামনে দাঁড়িয়ে দু’হাত তুলে উচ্চারণ করব, “প্রভু হে, আমাকে ক্ষমা করো! পাপ থেকে আমাকে রক্ষা করো!”

* আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু উপদেষ্টা সম্পাদক- উইকলি বাংলাদেশ, নিউ ইয়র্ক। সাবেক সম্পাদক- মাসিক নতুন ঢাকা ডাইজেস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *