ইয়ামা বারিজ ও এমিলি এটকিনসন বিবিসি
আফগানিস্তানে দুই দিন আগের ভূমিকম্পে এখন পর্যন্ত মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৪০০ জনে। এর মধ্যেই পূর্ব আফগানিস্তানে পাঁচ দশমিক দুই মাত্রার একটি নতুন আফটারশক আঘাত হেনেছে। ওই ভূমিকম্পে আহত হয়েছে তিন হাজারের বেশি মানুষ।
রোববারের ওই ছয় মাত্রার ভূমিকম্পের পর ভূমিধ্বসের কারণে উদ্ধার তৎপরতা জটিল হয়ে পড়েছে। কেননা এর ফলে রাস্তাঘাট বন্ধ হয়ে স্থলপথে চলাচল কঠিন করে তুলেছে।
প্রত্যন্ত গ্রামগুলোর ধ্বংসাবশেষের নিচে বেঁচে থাকা মানুষদের উদ্ধারের জন্য হেলিকপ্টার নিয়োজিত রয়েছে।অনেকেই ধ্বংসস্তুপের নিচে আটকে পড়েছেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। কেবলমাত্র রাশিয়ার স্বীকৃতি দেওয়া তালেবান সরকার আন্তর্জাতিক সাহায্যের আহ্বান জানিয়েছেন।
জাতিসংঘ জরুরি তহবিল ঘোষণা করেছে, যুক্তরাজ্য এক মিলিয়ন পাউন্ড (এক দশমিক তিন মিলিয়ন ডলার) সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
আফগানিস্তান সাধারণত ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা হলেও রোববারের ভূমিকম্পটি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হানা সবচেয়ে শক্তিশালী ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা জানিয়েছে, মঙ্গলবার দুপুর ১২ টা ২৯ মিনিটে (সাতটা ৫৯ জিএমটি) আফটারশকটি আঘাত হানে।
এর কেন্দ্রস্থল ছিল দেশের পঞ্চম বৃহত্তম শহর জালালাবাদ থেকে ৩৪ কিলোমিটার দূরে। এটা ছিল অগভীর, মাত্র ১০ কিলোমিটার গভীরে। উত্তর – পূর্ব কুনার প্রদেশের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোর মধ্যে একটি সাওকাই। ওই জেলায় অবস্থানরত বিবিসির একজন প্রতিবেদক জানিয়েছেন তারা তীব্র কম্পন অনুভব করেছেন। তবে নতুন করে কোনো ক্ষয়ক্ষতি বা হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।
কুনার প্রদেশের প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে যারা বেঁচে আছেন তাদের হেলিকপ্টারে করে সেখান থেকে বের করে আনা হচ্ছে। এই প্রদেশেই বেশিরভাগ নিহত ও আহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
একটি তালেবান সূত্র জানিয়েছে, মাজার উপত্যকার একটি এলাকায় ভূমি এতোই দুর্গম ছিল যে তিনবার চেষ্টা করেও সেখানে অবতরণে ব্যর্থ হয়েছে একটি হেলিকপ্টার। সেখানকার বেঁচে যাওয়া বাসিন্দা মারজানা বিবিসিকে বলেন, “আমরা গভীর, শান্তিপূর্ণ ঘুমে ছিলাম তখন হঠাৎ একটি ঝাঁকুনি এলো এবং পৃথিবী উল্টে গেলো।”
নিজ বাড়ির ধ্বংসস্তুপের নিচ থেকে তাকে উদ্ধার করা হয় বলে তিনি জানান। কিন্তু তার পরিবারের আরো কয়েকজন সদস্য ধ্বংসস্তুপের নিচে চাপা পড়ে গেছেন। তার আট নাতি – নাতনি এবং পূত্রবধু নিহত হয়েছেন বলে তিনি জানিয়েছেন।
দাতা সংস্থা সেইভ দ্য চিলড্রেন কুনার প্রদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে মানুষ উদ্ধার ও চিকিৎসার জন্য মেডিকেল টিম পাঠিয়েছে। সংস্থাটি জানিয়েছে, সেখানে হাজারো মানুষের জরুরি ভিত্তিতে খাদ্য, পানি এবং আশ্রয় প্রয়োজন।
ডা. শাহির নামে পরিচিত একজন স্বেচ্ছাসেবক বলেছেন, কিছু মানুষ নদীর পানি পান করতে বাধ্য হচ্ছেন। তিনি বলেন, “শিশুদের অবস্থা খুবই শোচনীয়। তারা যদি সহায়তা না পায় তবে ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার শিশুরা পুষ্টি, স্বাস্থ্য এবং অন্যান্য ঝুঁকির মুখোমুখি হবে।”
দাতব্য সংস্থা মেডিসিন সানস ফ্রন্টিয়ার্স জানিয়েছে, তাদের টিম দুইটি হাসপাতালে পৌঁছেছে। একটি নানগারহার প্রদেশে এবং আরেকটি লাঘমান প্রদেশে। এমএসএফের ডেপুটি মেডিকেল কোঅর্ডিনেটর ফজল হাদি জানিয়েছেন, মানবিক সহায়তা ” জরুরিভাবে বৃদ্ধি করা” প্রয়োজন।
তিনি বলেন, ” ভূমিকম্পের আগে ইতোমধ্যেই দুইটি হাসপাতাল পূর্ণাঙ্গ সক্ষমতায় কাজ করছিল। হাসপাতালের বারান্দায় অনেক রোগীকে চিকিৎসাধীন দেখেছি আমরা। স্বাস্থ্যকর্মীরা জরুরি সরঞ্জামের ঘাটতিতে ছিলেন।”
জালালাবাদের নানগারহার আঞ্চলিক হাসপাতালে ভুমিকম্পে বেঁচে যাওয়া নাদির খান দুই ছেলে ও দুই পুত্রবধুকে ভুমিকম্পে হারিয়েছেন স্মরণ করে কান্নায় ভেঙে পড়েন। ৬০ বছর বয়সী খান জানিয়েছেন, নাতি – নাতনিদের তিনি বাঁচাতে পেরেছিলেন কিন্তু তারা এখন কোথায় আছে তা তিনি জানেন না।
বিবিসিকে তিনি বলেন, “আমার মাথা ও মেরুদণ্ডে আঘাত লেগেছে তাই তাদের বাঁচাতে আমি নড়তে পারছিলাম না। আমার ছেলেদের মরদেহের কি হয়েছে তা আমি জানি না।”
মীর জামান বিবিসিকে জানিয়েছেন ধ্বংসস্তুপ থেকে নিজেই সন্তানের মরদেহ টেনে বের করেছেন। ” অন্ধকার ছিল, কোনো আলো ছিল না। কেউ একজন আমাকে একটা বাতি দিয়েছিলো, আমি কুড়াল ও বেলচা দিয়ে খুঁড়ে তাদের বের করে আনলাম। সাহায্যের জন্য সেখানে কেউই ছিলো না কারণ প্রত্যেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। আমার গ্রামে অনেক মানুষ মারা গিয়েছে। কেউ কেউ এখন চাপা পড়ে আছে। পুরো পরিবার মারা গেছে ” বলেন তিনি।
আড়াই বছর বয়সী মাইওয়ান্দ মাথায় আঘাত পেয়েছে এবং রক্তক্ষরণ হয়েছে তার। শিশুটির চাচা খাওয়াত গুল বলেন, ” আপনি তার অবস্থা দেখতে পাচ্ছেন। এটা খুবই মর্মান্তিক। ভূমিকম্পটা ভয়াবহ ছিলো। আমি চাই চিকিৎসকরা তাকে চিকিৎসা করে সুস্থ করে তুলুন।”
জালালাবাদের স্পিংঘার মেডিকেলের একজন চিকিৎসক বিবিসিকে জানিয়েছেন, রোববার থেকে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া একশজন রোগীর মধ্যে অর্ধেকই নারী।
ডা. নূর সাবা বলেন, মঙ্গলবার আরো ১৫ জন রোগীকে আনা হয়েছিলো যাদের অনেকেরই গুরুতর আঘাত ছিল। তিনি বলেন, “কারো মাথায় আঘাত, কারো মেরুদণ্ড আবার কারো কারো শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত ছিল। সাত বা আটজনের অস্ত্রোপচার করা হয়েছিল। একজনের পা ভেঙে গেছে আবার অন্য আরেকজনের পিঠে ভেঙে গেছে।”
আফগানিস্তানে সাম্প্রতিক এই ভূমিকম্প এমন এক সময়ে আঘাত হানে যখন দেশটি তীব্র খরায় ভুগছে। জাতিসংঘ একে অভাবনীয় ক্ষুধার সংকট বলে অভিহিত করেছে। এ বছর দেশটির ত্রাণ সহায়তা ব্যাপকহারে কমেছে বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের আবার সহায়তা কমানোয় বহু মানুষ যে সাহায্য পেত তা আরো কমে গিয়েছে।
যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র সচিব ডেভিড ল্যামি জানিয়েছেন, যুক্তরাজ্যের ত্রাণ সহায়তা জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল ও আন্তর্জাতিক রেডক্রসের মতো ” অভিজ্ঞ অংশীদারদের মাধ্যমে” পরিচালিত হবে।
দিল্লির পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, কাবুলে এক হাজার তাঁবু এবং কুনার প্রদেশে ১৫ টন খাদ্য সহায়তা এরই মধ্যে পাঠানো হয়েছে। চীন এবং সুইজারল্যান্ডও সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।