আত্মগত দার্শনিক । মুসা আল হাফিজ

সময় সাহিত্য সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

প্রসঙ্গকথা : মুসলিম স্পেনের প্রধান এক দার্শনিক ইবনে তুফায়েল (১১১০-১১৮৫) ছিলেন মরোক্কো ও স্পেনের সুলতান আবু ইয়াকুব ইউসুফের একজন মন্ত্রী ও চিকিৎসক । কবিতা, দর্শন, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, পদার্থবিজ্ঞান এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে তিনি ছিলেন বরেণ্য। ইবনে রুশদের (১১২৬-১১৯৮) গুরু ছিলেন তিনি। তার প্রধান গ্রন্থ হাই ইবনে ইয়াকজান দুনিয়ার চিন্তার ইতিহাসে সবচেয়ে প্রভাবশালী গ্রন্থগুলোর একটি। ১১৬০ বা ১১৭০ খ্রিস্টাব্দে গ্রন্থটি রচিত হবার পরে আজ অবধি গ্রন্থটি আপন গুরুত্ব ধরে রেখেছে। ইউরোপের বিখ্যাত বহু দার্শনিক এবং বিজ্ঞানীদের চিন্তা ভাবনায় এ গ্রন্থ গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে । যাদের মধ্যে আছেন থমাস হবস (১৫৮৮-১৬৭৯), জন ওয়ালিস (১৬১৬-১৭০৩), জন লক (১৬৩২-১৭০৪), আইজ্যাক নিউটন (১৬৪৩-১৭২৭), গটফ্রিড লাইবনিজ (১৬৪৬-১৭১৬), জর্জ বার্কলি (১৬৮৫-১৭৫৩), ডেভিড হিউম (১৭১১-১৭৭৬), ইমানুয়েল কান্ট (১৭২৪-১৮০৪), শোপেনহাওয়ার (১৭৮৮-১৮৬০) সহ অনেকেই। ইতালিয় দার্শনিক পিকো ডেলা মিরান্ডোলার (১৪৬৩-১৪৯৪) হাত দিয়ে ত্রয়োদশ শতকের ষাটের দশকে বইটি ল্যাতিনে অনূদিত হবার পরে বহু ভাষায় তার বহু অনুবাদ হয়, তাকে অবলম্বন করে রচিত হয় বহু গ্রন্থ। একে অবলম্বন করে নতুন রচনার সূচনা হয় ১৬৫১ খ্রিস্টাব্দে স্প্যানিশ ভাষায় রচিত El Criticón নামক বিখ্যাত গ্রন্থের মধ্য দিয়ে । ইবনে তুফায়েলের হুবহু অনুকরণে রচিত এ গ্রন্থে হাই এর চরিত্র নিয়েছে জনৈক আন্দ্রেনিও। এ বই সম্পর্কে ঊনবিংশ শতকের জার্মান দার্শনিক শোপেনহাওয়ার বলেন যে, এখন পর্যন্ত যতো বই লিখা হয়েছে, এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বইগুলোর একটি। পরবর্তীতে হাই এর নানামাত্রিক প্রভাব দেখা গেছে টমাস ম্যুর এর ইউটোপিয়া (১৫১৬) টমাস হবস এর লেভিয়াথন (১৬৫১ ) ড্যানিয়েল ডিফো এর রবিনসন ক্রুসো (১৭১৯) জোনাথন সুইফট এর গ্যালিভার্স ট্রাভেলস (১৭২৬) ইত্যাদি গ্রন্থে।
আত্মগত দার্শনিক মূলত হাই ইবনে ইয়াকজান এর ছায়া অবলম্বনে রচিত। এ উপন্যাস মানবীয় ফিতরাতের দার্শনিক অনুসন্ধানের মধ্য দিয়ে সহজাত সত্যসন্ধানের বিভূতির সাথে পাঠক মনের বন্ধন গড়তে চায়।

যাত্রা
জল আর ফেনা দিয়ে রচিত তার দিন রাত্রির পান্ডুলিপি। বাতাস আর বৃষ্টির তরঙ্গে আন্দোলিত তার জীবনের শ্বাস-প্রশ্বাস। স্রোত আর ঘূর্ণির আবেগে গতিময় তার স্বপ্নের জলধারা। ক্ষুধার্ত ঢেউয়ের মাথায় রূপালি তারে যখন সমুদ্রের বীণা বেজে ওঠে, ওজুদ তাতে শুনতে পান আপন সত্তার অনুরণন। সমুদ্র তাকে মুক্তি দিয়েছে গতানুগতিকতার কারাগার থেকে। সমুদ্র তার কাছে জীবনের অপরাজেয় উল্লাস।
যৌবনের প্রথম সমুদ্র সফর ওজুদকে দেয় ভীতিহীন দ্বিতীয় জীবন। সমুদ্রে তিনি আবিষ্কার করেন আশ্চর্য এক প্রেম। যেখানে আকাশের সবচেয়ে দূরবর্তি নক্ষত্রও সাগরের জলে পা ডুবিয়ে গেয়ে চলে রহস্যের সংগীত। আর জ্যোৎস্নার ভাষায় রাত্রির গতরে চাঁদ ছড়িয়ে দেয় আরো বেশি অনুরাগের বর্ণমালা। কিন্তু এ তল্লাটে শুধু ওজুদের হৃদয় বাধা পড়েছে সমুদ্রের মায়ায়। অন্য অনেকের কাছে সমুদ্র যেনো মৃত্যুর গহ্বর। পাল খাটানো কিশতি নিয়ে সমুদ্র সফর মানেই তুফানের সাথে সম্মুখ লড়াই। উল্টো বাতাস জাহাজ থামিয়ে দেবে। ঘূর্ণিঝড় পাল ছিঁেড় দেবে। জলদস্যু সর্বস্ব লুটে নেবে। সমুদ্র জোয়ার জাহাজ ডুবিয়ে দেবে।
এতো বিপদের মুখোমুখি কে দাঁড়াতে চায়? লোকেরা চাইতো না। বাধ্য না হলে সামুদ্রিক সফরে যেতো না। ওজুদের বসবাস ছিলো ভারতীয় সেই দ্বীপে, যেখানে বাড়ীর পাশে নিবিড় বনানী, মুখর প্রান্তর আর ছড়ানো ছিটানো টিলা। মাঝে মাঝে বন কেটে তৈরি হাস্যময় শস্যভরা জনপদ। যার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে স্রোতোময় নদী। নদীতে ওজুদ সাঁতার কেটেছেন। শিখেছেন নৌকা বাওয়া। এক ঘাট থেকে দূরবর্তি আরেক ঘাটে নৌকা নিয়ে ছুটে যাওয়া দুরন্ত ওজুদ দারুন গাইতেন কৈশোরে। ঘুঘু ডাকা দুপুরে যখন তখন ওজুদের সুর ধ্বনিত হতো …..ও জীবন নদীর নাইয়া/অচিন দেশে যাওরে নৌকা বাইয়া …।
ভরাট গলা ছিলো ওজুদের। তার সুরের মুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়তো নদীর দুধারে, কৃষ্ণচূড়ার ডালে, ফুটন্ত লাল ফুলে, বুনো লতাপাতার শিহরণে, প্রবীণ বটের উদার ছায়ায়, বহমান সবুজ বাতাসে, এমনকি গাঙশালিকের গর্তে। সবুজ মাঠের সহাস্য আমন্ত্রণের চেয়ে নদীর কলতানই ওজুদকে মুগ্ধ করত বেশি। কৈশোরে নৌকা বেয়ে বেয়ে চলে যেতেন নোনাজলের সেই মোহনায়, যেখানে নদী বিরাট অজগরের হা হয়ে সাগরে মিশে গেছে । লোকেরা বলতো ছেলেটির রক্তে যেনো নির্ভীক সমুদ্র স্রোতে দাড় ফেলা এক জাহাজির বসবাস। সে একদিন নামকরা নাবিক হবে। হলোও তাই।ওজুদ বিয়ে করে ব্যবসার জন্য দূর দেশে সমুদ্র সফর শুরু করলেন। সমুদ্র উপকূলের এক শহবে গড়লেন বাসা। পাখির নীড়ের মতো বাসাটিতে থাকতেন ওজুদের স্ত্রী ইশক, পুত্র সায়ী আর কন্যা সুরুর। সায়ী মানে সাধনা আর সুরুর মানে আনন্দ। সাধনার সাথে সংযোগ গড়তে চায় সায়ী। বারো বছরের দরোজায় পা দিয়েছে। উর্ধ্বমুখী বৃক্ষের আনন্দে যেনো দুলছে তার দিন রাত। সুরুর অতিক্রম করেছে জীবনের নয়টি বসন্ত। তার দিন রাত যেনো চঞ্চল প্রজাপতির পাখায় আঁকা আলপনা। ওজুদের আরেক ছেলে এক বছরের দুগ্ধপোষ্য কুঁড়ি। নাম হায়াত । এদের নিয়ে তরুণ রোদে ঝলমল করা পরিবারটি হয়ে ওঠেছিলো মুখর বাগান।
ওজুদ থাকতেন সাগরে সাগরে। পালের কিশতি ছুটিয়ে বন্দরে বন্দরে মালামাল নিয়ে ঝড়ো বাতাসের মতো সফরে সফরে কেটে যেতো তার সারা বছর। কখনো নিজ বন্দরে এলে ছেলে-মেয়েদের প্রাণময় উষ্ণতায় কিছুদিন কাটিয়ে দিতেন নিজ বাসায়। তারপর আবার সাগরের ডাক। আবার সুদূরের পথে যাত্রা। আবার কেশর ফোলানো সাদাতাজির মতো তার কিশতি সাগরজলে ছুটতো। দীর্ঘ সফরের ক্লান্তি নিয়ে একদিন ওজুদ বাড়ী ফিরলেন। থাকা হলো ক‘দিন। সামনে তার আরো দীর্ঘ সফর। স্ত্রীকে বললেনÑ আমি যাচ্ছি দীর্ঘ এক বাণিজ্য যাত্রায়।
ঃ কোথায়? কোথায়?
ঃ সমুদ্রের ওপারে। পশ্চিম বন্দরে
ঃ কবে সেই সফর?
ঃ আগামী কালই
Ñইশকের দু’চোখে হাতাশা, চেহারায় দূর্ভাবনা।
ওজুদ বললেন: এ যাত্রায় তোমাদের সাথে করে নিয়ে যাবো। তোমাদের ছাড়া একা থাকলে খালি লাগে সব কিছু। ভালো লাগা কাছে থাকে না।
ঃ কতো দিনের সেই সফর?
ঃ সমুদ্রযাত্রা। বাতাসের মতি-গতির উপর নির্ভর করে অনেক কিছু। তবে সব দিক ঠিক থাকলে ছ’মাসের সফর।
ঃ এ সফর বাদ দিলে চলে না? এ তো দীর্ঘ ঝুঁকি! এ তো বিপদের সাথে পাঞ্জা লড়া! কম বিপদের কাজ হাতে নাও। হোক তা ছোট। নিজেকে বাঁচিয়ে ছোট অর্জনেও সাফল্য আসে।
ঃ না, দীর্ঘ সফরই বর্তমানের চাহিদা। এতো দিনের বাণিজ্যযাত্রা আমাকে এই জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে। ঝুঁকি যেখানে বেশি, সেখানে অর্জনও থাকে অধিক। দরিয়াকে আমি বাসস্থান বানিয়েছি। সেখানে আমার জীবন। তাকে যদি ভয় পেতে থাকি, তাহলে তো আমি জীবন থেকে পলায়ন করবো। যোদ্ধা থাকবো না। নাবিক থাকবো না।
সায়ী ও সুরুর মা-বাবার পাশেই দাঁড়িয়ে। বাবাকে তারা সমর্থন করলোÑ ঠিক বলেছেন বাবা।
মা বললেন:Ñ তোমরা জানো না সমুদ্র কি জিনিস! সমুদ্র মানেই অতিকায় সাপের ছোবল … কুমীরের করাতী দাঁত … ধেয়ে আসা বরফের পাহাড় … তুফানের অন্ধ ঝাপটা … ধ্বংসপাগল ঝড়ের তান্ডব। মানুষের কাজ বিপদের সামনাসামনি না দাঁড়ানো। যখন তোমার সামনে রয়েছে মুক্ত সড়ক, তখন তুমি স্বেচ্ছায় কাদায় নেমে গেলে তা হবে দয়াময়ের দয়ার অবমাননা। এড়ানো যায়, এমন বিপদকে এড়ানোর মাঝেই বুদ্ধিমত্তা।
ঃ দেখো, বিপদ শুধু মাতাল সাগরে নয়, স্নিগ্ধ বনানীতেও আছে। সাপ শুধু দরিয়ার কিনারে নয়, পাহাড়ের ধারেও লুকিয়ে থাকে। বিদ্যুৎগর্ভ কালো মেঘে ছেয়ে যাওয়া আকাশ এই শহরের মাথার উপরেও দেখা যায়। অরণ্যে বাঘের ঝাপটায় প্রাণ হারালো ও পাড়ার যে লোকটি, তার শোকে আজো বাতাস ভারাক্রান্ত। সে তো সমুদ্রে ছিলো না। পাহাড়-প্রান্তর, শহরÑগ্রাম, বিপদ যে কোনো জায়গায় ঘটতে পারে।

এই যে গত বছর কুমারপল্লীর দুটি লোক শীতে কাবু হয়ে মারা গেলো, আমার বন্ধু ওফা পর্যটনে গিয়ে পাহাড়ী পাথরের তলে পড়ে মারা গেলো, তকদীরের এই সব অঘটন যার ক্ষেত্রে ঘটবার, যে কোন জায়গায় ঘটতে পারে। আসলে বিপদ জীবনেরই সহযাত্রী। যেখানে জীবন গতিশীল , সেখানেই বিপদের পদধ্বনি। কোথাও সন্ত্রাস, কোথাও চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র, কোথাও স্বৈরাচার, কোথাও মহামারি জীবনের শস্যখেতে বিনাশের আয়োজনে ব্যস্ত। জাহাজডুবি এমনই ঘটনা সমূহের একটি।

(ধারাবাহিক চলবে)

আরও পড়ুন
কোথাও আগুন লাগলে সতর্কতার জন্য যা করবেন, যা করবেন না
আগুনে পুড়লে মৃত ব্যক্তির মর্যাদা ও আগুন লাগলে যে দোয়া পড়বেন
দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়ছে মাঙ্কিপক্স; প্রয়োজন সতর্কতা
দেহকে সুস্থ রাখবে অ্যালোভেরা
বসন্তের বাতাসে অ্যালার্জির প্রবণতা, একটু গাফিলতি হলেই মারাত্মক বিপদ
রাসূল সা: প্রবর্তিত খাদ্যবিজ্ঞান । ডা: মো: তৌহিদ হোসাইন
তরমুজের উপকারিতা ও পুষ্টিগুণ
যে খাবারে শিশুর উচ্চতা বাড়ে
ইন্ডাস্ট্রির সকলের স্বার্থে কপিরাইটের প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছিঃ ফাহিম ফয়সাল
অতিরিক্ত আবেগ মনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে
আক্ষেপ প্রকাশ করলেন ‘ছুটির ঘণ্টা’র নির্মাতার মেয়ে বিন্দি
ওজন কমাতে সাহায্য করে যে সকল খাবার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *