অ্যারন বুশনেলের আত্মহননে বিশ্ব বিবেক জাগবে তো?

আমেরিকা মধ্যপ্রাচ্য সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

সাঈদ চৌধুরী

অ্যারন বুশনেল চলে গেছেন পরপারে। বেছে নিয়েছেন অপরিমেয় যন্ত্রণার পথ। নাড়া দিয়ে গেছেন সারা পৃথিবীর বিবেক সম্পন্ন সকল মানুষকে। ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলের হত্যাযজ্ঞে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন মেনে নেননি। চোখের সামনে প্রায় ৩০ হাজার মানুষের খুন বরদাস্ত করতে পারেননি অ্যারন।

বিশ্ব বিবেক জাগাতে আত্মহননের মত কঠিন পথ বেছে নিয়েছেন অ্যারন বুশনেল। ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ‘হোয়াইট ফসফরাস’ ব্যবহার করেছে ইসরায়েল। এমন দাহ্য রাসায়নিক তাদের ত্বক পুড়িয়ে দেয়। অ্যারন বুশনেল প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে নিজের শরীরে সেই দাহ্য রাসায়নিকই ব্যবহার করেছেন।

ইসরায়েলি বাহিনীর মারণাস্ত্রের আঘাতে ফিলিস্তিনিদের প্রাণ দেওয়াটা দেখতে দেখতে আহত বেদনার্ত, ব্যথাতুর অ্যারন বুশনেল মৃত্যুর মুখে দাড়িয়ে বললেন, ঔপনিবেশিকদের (ইসরায়েল ও তাদের মিত্রদেশ) হাতে ফিলিস্তিনিরা যে অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হচ্ছেন, সে তুলনায় তাঁর এ কাজ কিছুই না।

অ্যারন বুশনেল ছিলেন মার্কিন বিমানবাহিনীর সক্রিয় সদস্য। গত রবিবার বিকেলে ওয়াশিংটনে ইসরায়েলি দূতাবাসের বাইরে নিজের শরীরে আগুন ধরিয়ে দেন। গাজায় ইসরায়েলি হামলার প্রতিবাদে এমনটি করেছেন বলেই জানা গেছে।

সংবাদ সংস্থা এএফপি জানিয়েছে, লোকটি প্রতিবাদ চিত্রায়িত করেছে এবং সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম টুইচ-এ লাইভ স্ট্রিম করেছে। তখন ক্লান্ত অবস্থায় ওই ব্যক্তিকে বলতে শোনা যায়, ‘আমি আর গণহত্যায় জড়িত হব না’। এরপরই তিনি নিজের শরীরে তরলজাতীয় দাহ্য পদার্থ ঢেলে আগুন ধরান। মাটিতে পড়ে না যাওয়া পর্যন্ত তাঁকে চিৎকার করে বলতে শোনা যায়, ‘ফিলিস্তিনকে মুক্ত করো’।

নিউইয়র্ক টাইমস নিশ্চিত করতে পারেনি যে ভিডিওটি পোস্ট করা অ্যাকাউন্টের পিছনে কে ছিল, তবে ভিডিওটিতে একজন ব্যক্তিকে ওয়াশিংটনে ইসরায়েলি দূতাবাসের দিকে হাঁটতে দেখা গেছে।

শহরের দমকল বিভাগের মুখপাত্র ভিটো ম্যাগিওলো বলেছেন, ইউএস সিক্রেট সার্ভিসের কর্মকর্তারা দুপুর ১টার দিকে উত্তর-পশ্চিম ওয়াশিংটনে দূতাবাসের বাইরে আগুন নিভিয়ে ফেলেন। তবে লোকটির অবস্থা গুরুতর। তাকে নিকটবর্তী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পরদিন সোমবার হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। ২৫ বছর বয়সী অ্যারন নিজের গায়ে আগুন দেওয়ার সময়ও সামরিক বাহিনীর পোশাকে ছিলেন।

যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যে বেড়ে ওঠা অ্যারন বুশনেলের জন্ম টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের স্যান আন্তোনিও শহরে। শিক্ষা জীবন শুরু করেছেন সেখানকার কেপ কড উপদ্বীপের সরকারি স্কুলে। তারপর কম্পিউটার সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছেন সাউদার্ন নিউ হ্যাম্পশায়ার ইউনিভার্সিটিতে। পরে ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ড গ্লোবাল ক্যাম্পাসে পড়েছেন কম্পিউটার বিজ্ঞান।

মার্কিন বিমান বাহিনীর মুখপাত্র অ্যান স্টেফানেক গত রাতে নিশ্চিত করেছেন যে, লোকটি একজন সক্রিয়-ডিউটি এয়ারম্যান ছিলেন। মূলত ২০২০ সালের মে মাস থেকে মার্কিন বিমানবাহিনীতে সক্রিয়ভাবে দায়িত্ব পালন করছেন অ্যারন। সে বছর নভেম্বরে বিমানবাহিনীর প্রাথমিক প্রশিক্ষণে ‘সেরা’ হয়েছিলেন। ‘কোড ব্যবহার করে জটিল সমস্যা সমাধানের প্রতিভা’ রয়েছে তাঁর। কাজ করেছেন বিমান বাহিনীর ৭০তম গোয়েন্দা, নজরদারি ও অনুসন্ধান শাখায় একজন সাইবার প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা হিসেবে। দায়িত্ব পালন করেছেন বিমানবাহিনীর ৫৩১তম ইন্টেলিজেন্স সাপোর্ট স্কোয়াড্রনেও।

সামাজিক বা রাজনৈতিক আন্দোলনে অনেক কিছুই প্রতিবাদের প্রতীক হয়। সংস্কার বা পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত করে। শিল্পমান বিবেচনায় অ্যাক্টিভিস্টদের সৃজনশীল কর্মকান্ড প্রতিবাদের আগুনকে জাগিয়ে তোলে।

পৃথিবীর অনেক সংগ্রামী ও বিপ্লবী মানুষ প্রতিবাদের প্রতীক হয়েছেন। প্রতীক হয়েছে আরো অনেক কিছু। কিন্তু প্রতিবাদ করতে গিয়ে অ্যারন বুশনেলের আত্মাহুতির ঘটনায় বহু মানুষ হতবিহ্বল হয়েছেন।

ফরাসি বিপ্লব থেকে উদ্ভূত হয়েছিল ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনে শ্রমিক শ্রেণীর উত্থাপিত মুষ্টি। মুষ্টিবদ্ধ হাত এখনো বিশ্বজুড়ে প্রতিবাদের প্রতীক।

২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ইরাকের বাগদাদে এক সাংবাদিক সম্মেলনে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জজ ডব্লিউ বুশের প্রশ্নের বদলে তাঁর দিকে উড়ে এল জুতা! ইরাকি সাংবাদিক জাইদি সেদিন গ্রেফতার হলেও তার জুতা হয়েছিল বিশ্বজুড়ে প্রতিবাদের প্রতীক।

২০১৪ সালে থাইল্যান্ডে অভ্যুত্থান বিরোধী বিক্ষোভে স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে তিন আঙুলের স্যালুট ছিল অবাধ্যতার প্রতীক।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নারীদের নিয়ে কটূক্তি করায় ২০১৭ সালে গোলাপি টুপি মাথায় নিয়ে সমবেত হন অসংখ্য নারী। তখন গোলাপি রং হয়ে ওঠেছিল নির্দিষ্ট ইস্যুতে প্রতিবাদের প্রতীক।

২০১৯ সালে চিলির গণবিক্ষোভে অংশ নিয়ে প্রতিবাদের প্রতীক হয়েছিলেন ড্যানিয়েলা কারাসকো (লা মিমো)। সেদেশের পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেছিল। ২০শে অক্টেবর একটি পার্কের প্রাচীরে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া যায় তার প্রাণহীন দেহ। লা মিমো হয়ে ওঠেছিলেন প্রতিবাদের প্রতীক।

২০২২ সালে ভারতের কর্ণাটকে হিজাব পরতে বাধা দেয়ায় এক শিক্ষার্থীর প্রতিবাদ স্ফুলিঙ্গ হয়ে দেশব্যাপী তোলপাড় সৃষ্টি করেছিল, নাড়িয়ে দিয়ে ছিল গোটা রাষ্ট্রকে। মুসকান খানের ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি এখনো ভারতজুড়ে প্রতিবাদের প্রতীক।

প্রতিবাদের প্রতীক হিসেবে কেউ যাথে এই পথ বেছে না নেয়, আত্মহত্যার মত প্রতিবাদ যেন কোথাও না ঘটে, তা নিয়ে দুনিয়াজুড়ে এখন শুরু হয়েছে ব্যাপক ভাবনা ও গবেষণা।

বিশ্বের প্রায় কোথাও আত্মহত্যাকে সক্রিয়ভাবে উৎসাহিত করা হয় না। ট্রিনিটি কলেজ ডাবলিনের সাইকিয়াট্রির অধ্যাপক এবং সাম্প্রতিক ইতিহাস ইন সার্চ অফ ম্যাডনেসের লেখক ব্রেন্ডন কেলি বলেছেন, কিছু লোক “তারা যা করছে তার বিকল্প দেখতে ব্যর্থ হয়।” অনেক লোক যারা তাদের জীবন শেষ করে বলে, “আমার আর কোন উপায় ছিল না।”

তাহলে এর দায়তো কাউকে নিতে হবে। অ্যারন বুশনেলের আত্মহননের অপরিমেয় যন্ত্রণা দেখে বিশ্ব বিবেক জাগবে তো?

* সাঈদ চৌধুরী সময় সম্পাদক, কবি ও কথাসাহিত্যিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *