অরওয়েলের ‘পশুর খামার’ বনাম গণশত্রু স্কুয়েলারগণ

প্রবন্ধ-কলাম মতামত
শেয়ার করুন

মুসা আল হাফিজ

ম্যানর ফার্মের মালিক মি. জোন্স। রাতের বেলা মুরগির খোঁয়াড়ের দরজা বন্ধ করলেন। কিন্তু মদে চুর হয়ে যাওয়ার কারণে দরজার ছিটকিনি লাগাতে ভুলে গেলেন। শয়নকক্ষে গেলেন বিয়ারের বোতল সাবাড় করতে করতে। বাতি নেভাতেই শুনলেন হইচই, পাখা ঝাপটানোর শব্দ। তার ফার্মের প্রাণীরা জড়ো হয়েছে। মেজর নামক পশুদের নেতা বুড়ো শূকর বক্তব্য রাখছে। তারা ম্যানরের অত্যাচারে অতিষ্ঠ। তাদের সে উচিত খাবার দেয় না, করে চলে অত্যাচার। সবাই জীর্ণশীর্ণ। দুর্গতি তাদের ঘিরে ধরেছে। তাদের প্রয়োজন মুক্তি। সে জন্য মনুষ্যশ্রেণীর বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। বুড়ো শুয়োর মেজর বলে, সারা পৃথিবীতে এই মানুষেরাই শুধু কাজ না করে আরামে জীবন কাটায়। ডিম দেয় না, দুধ দেয় না, লাঙ্গল টানে না, এমনকি একটি খরগোশ ধরার জন্য দৌড়ালে খরগোশের পিছনে পড়ে যায়, অথচ ওরা কি না আমাদের মনিব। সারা দিন একটা পশুকে গাধার মতো খাটিয়ে সামান্য খাবার দেয় আর সব খাবার নিজেরাই গিলে খায়। এই ফার্মের মালিক জোন্স হচ্ছে মানুষদের এক নমুনা। এরা খারাপ। এদের উচ্ছেদ করে পশুদের বিপ্লব ঘটাতে হবে। তখন সব পশু হবে সুখী, মুক্ত, নিষ্পাপ।

বুড়ো মেজর এই স্বপ্ন জাগিয়ে দেয় সব পশুর মনে। একদিন তার মৃত্যু হলেও ফার্মের প্রাণীরা বিপ্লবের স্বপ্নে ব্যাকুল থাকে। তারা অত্যাচারী শোষক জোন্সকে তাড়াবার জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়। একদিন সম্মিলিত আক্রমণে জোন্স বিতাড়িত হয়, ফার্মের নামও বদলানো হয়। ম্যানর ফার্ম হয়ে উঠে অ্যানিমাল ফার্ম!

আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয় ঘোড়ার জিন, ঠুলি, চাবুক এবং এমন সব জিনিস, যা পশুশ্রেণীর পরাধীনতার ইতিহাস মনে করিয়ে দেয়। খামারে প্রতিষ্ঠিত হয় পশুবাদ, জারি করা হয় সাতটি নিয়ম, যা পালন করতে হবে প্রতিটি পশুকে। নিয়মগুলো হলো, দু’ পেয়ে প্রাণী বলতেই শত্রু, যারা চার পায়ে চলে এবং যাদের পাখা আছে, তারা বন্ধু। কোনো পশুই কাপড় পরিধান করতে পারবে না। কোনো পশুই বিছানায় ঘুমাতে পারবে না। কোনো পশুই মদ্যপান করতে পারবে না। এক পশু অন্য পশুকে হত্যা করতে পারবে না এবং সব পশুই সমান।

শুয়োরদের মধ্যে বুদ্ধিমান স্নোবল লিখিত নিয়মগুলো ঝুলিয়ে দেয় খামারের দেয়ালে। সে খামারের শিক্ষিত পশু। সবাইকে বর্ণমালা শেখানোর কাজ হাতে নিয়েছিল সে। এর মাধ্যমে হয় জনপ্রিয়। সে চেষ্টা করে বুড়ো মেজরের স্বপ্নের বাস্তবায়নে। মেজরের মৃত্যু হলে নেপোলিয়ন নামের শুয়োর আর স্নোবল পশুদের নেতৃত্ব গ্রহণ করে। পশুদল ঐক্যবদ্ধ, নতুন বিপ্লব এসেছে, মুক্তি হয়েছে নিশ্চিত। পশুরা কৃষিকাজ করে, ফসল বোনে, ফসল ঘরে এনে মাড়াই দেয়, কিছু খায়, কিছু আগামীর জন্য জমিয়ে রাখে। তারা দুধ বিক্রি করে, বাচ্চা ফুটাবে বলে ডিম সংরক্ষণ করে, শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন করে, শিক্ষার প্রচার করে।

খামারের উচ্ছেদ হওয়া মালিক জোন্স এতদিন চুপচাপ বসেছিলেন, তা নয়। তিনি একদল মানুষ নিয়ে খামারের দিকে আসছেন, খবর জানাল কবুতর। পশুদলে ছড়িয়ে পড়ে ভয়, আতঙ্ক। খামারেও শুরু হয় ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। স্নোবলের প্রতিটি কাজের বিরোধিতা করে নেপোলিয়ন। স্নোবল চায় পশুদের জন্য বায়ুকল বানাবে, নেপোলিয়ন বিরোধিতা করে। যুক্তির বদলে শুরু হয় সন্ত্রাস। নেপোলিয়নের অনুগত একদল কুকুর স্নোবলকে চরমভাবে ধাওয়া করে। হত্যার চেষ্টা করে। ফার্ম থেকে খেদিয়ে দেয়।

নেপোলিয়ন গোপনে হাড়গোড় খাইয়ে মোটাতাজা করেছে এই কুকুরদের। তারা তার ইশারায় কাজ করে। নেপোলিয়নবিরোধী সবাইকে বন্দী করে তারা। নেপোলিয়ন এবার হাওয়াকল নির্মাণে উদ্যোগী হয়। সে দাবি করে, কল বানানোর বিষয়টি মূলত তারই চিন্তার ফসল। স্নোবলের হাত দিয়ে তা বানানো হলে সর্বনাশ হয়ে যেত। সব পশুকে বলা হলো, খামারের জন্য আরো বেশি ত্যাগ দরকার। কেউ কোনো বিষয়ে প্রতিবাদ করতে চাইলে কুকুরদের হাড়কাঁপানো গর্জনে থেমে যেত। সবাইকে বলা হতো বিপ্লবকে দীর্ঘজীবী করতে হবে। সবাইকে করে যেতে হতো পরিশ্রম।

হাওয়াকল নির্মিত হয়। শুয়োররা কাজে দেয় নেতৃত্ব। তারা শাসকগোষ্ঠী। তারা নিজেদের আস্তাবল ছেড়ে খামার বাড়ির বাসগৃহে এসে আস্তানা গাড়ল। কিন্তু বিপ্লবের দাবি হলো, সব পশু সমান অবস্থানে থাকবে, মানুষের বাসস্থানে কোনো পশু থাকবে না। এবার বলা হলো, শুয়োররা যেহেতু পুরো খামার পরিচালনা করছে, তাই তাদের মনোরম বাসগৃহ খুব দরকার। সাত নিয়মের অন্যতম নিয়ম ছিল পশুদের কাপড় পরিধান করতে নেই, বিছানার ব্যবহার থাকতে নেই, শুয়োররা তা বেমালুম ভুলে গেল। তারা তা করল। অন্যদের তুলনায় বেশি খেতে লাগল। যুক্তি হলো, যেহেতু মেধা দিয়ে তারা সব পশুকে পরিচালনা করছে, তাই সবারই স্বার্থে তাদের বেশি খাওয়া খুব দরকার।

পশুদের মধ্যে তৈরি হয় ক্ষোভ। নেপোলিয়নের সহযোগী স্কুয়েলার আরেক শুয়োর। বেঁটে, খাটো, গোলাকৃতির মুখ, চোখ দুটো উজ্জ্বল, স্তাবক, বাকচতুর। কঠিন বিষয়কে সহজে ব্যাখ্যা করতে দক্ষ। সে হয় নেপোলিয়নের সব কাজের ভাষ্যকার।

যখনই প্রজারা কোনো অন্যায়ের প্রতিবাদে সচেষ্ট হয়, সে অন্যায়ের পক্ষে এমন ধূম্রজালপূর্ণ ব্যাখ্যা পেশ করে, যাতে পশুরা হতবিহবল হয়ে যায়। নেপোলিয়নের সম্মানকে সুউচ্চে তুলে ধরতে সে চেষ্টা করে, তার গুণকীর্তন করে, অন্যদের দিয়ে করায়। তাকে অভিহিত করে মহান নেতা ও পরিত্রাতা অভিধায়। সে সবাইকে বুঝায়, যা হচ্ছে, ভালোই হচ্ছে, এটাই মহৎ পরিচালনা। এর চেয়ে ভালো বিকল্প আছে কোথাও? কী হতে পারে? কে হতে পারে? সবাইকে তাই খুশি থাকা উচিত।

খামারের মূল মালিক অনেক চেষ্টা করে আশা হারিয়ে ফেলে। খামার সে আর ফেরত পাবে না! শুয়োররা বৈষম্যহীন শাসন প্রতিষ্ঠার নামে নিজেদের জন্য সব সুযোগ কেন্দ্রীভূত করতে করতে এই ভয় হারিয়ে ফেলে যে, তাদের শাসনের অবসান হতে পারে। ইতোমধ্যে তারা পশুদের খাবারের পরিমাণ কমিয়েছে, কিন্তু নিজেদের খাবার বাড়িয়েছে। পশুদের কর্মঘণ্টা বাড়িয়েছে, নিজেদেরটা বাড়ায়নি। দুই পায়ে চলে, এমন প্রাণীদের সাথেও বন্ধুত্ব করে তারা। পশুরা লক্ষ করে, যে নিয়মের ভিত্তিতে বিপ্লব হয়েছিল, তার সবই লঙ্ঘিত হয়েছে। তবুও পরিশ্রমী ঘোড়া বক্সার খেটে চলে প্রাণপণ, ক্লান্তিহীন ক্লোভার কাজ করে যায় বঞ্চিত হয়েও; তাদের আশা বৃদ্ধ মেজরের সেই স্বপ্নপূরণ, সেই দর্শনের বাস্তবায়ন, সেই সত্যিকার অ্যানিম্যাল ফার্ম প্রতিষ্ঠা।

কিন্তু কী হলো এত দিনে? পরিশ্রম পশুদের কমেনি, বরং বেড়েছে। সে অনুপাতে তারা সুখ পেল কই? ঝড়ের দাপটে একদা ভেঙে যায় হাওয়াকল, আবার তার পুনর্গঠন হয়, তীব্র শীতে পরিশ্রম বাড়িয়ে দেয়া হয়। এর মধ্যে দেখা দেয় ভয়াবহ খাদ্যাভাব। কিন্তু নেপোলিয়নকে এসবের কিছুই স্পর্শ করে না। সে নিজের সুখ নিয়ে থাকে সারা দিন। তাকে পাহারা দেয় কুকুরের দল। নেপোলিয়নের হয়ে সব কিছুর ওপর নজরদারি করে স্কুয়েলার। হাওয়াকলের নাম রাখা হয় নেপোলিয়নের নামে।

মুরগির ডিম বিক্রি হবে না, এটাই ছিল রীতি। বিক্রি করা হয় ডিম। এজন্য হয় মুরগি বিক্ষোভ। একের পর এক লঙ্ঘন করা হয় নিয়ম। মদ্যপান নিষিদ্ধ ছিল। তা জারি হয় প্রবলভাবে। স্বেচ্ছাচারের প্রতিবাদে হয় বিদ্রোহ। কিন্তু বিদ্রোহীদের দেয়া হয় সর্বোচ্চ শাস্তি। ক্রমেই খামারের দেয়াল থেকে একে একে বিলুপ্ত হয় সব নীতিমালা। একসময় সব নীতিমালা মুছে ফেলা হয় দেয়াল থেকে। সেখানে থাকে কেবল একটি নীতি; সব পশুই সমান। কিন্তু কিছু পশু অন্য পশুদের থেকে আলাদা।

এ নীতি হয় সব নীতির নীতি, একমাত্র নীতি। এর পরের দিন থেকে শুয়োররা চাবুক হতে সব পশুর কাজের তদারকি শুরু করল। আগে যা করত মানুষ এবং যে কারণে মানুষের হাত থেকে মুক্তির জন্য বিপ্লব করা হয়। শুয়োররা নিয়মের অবসান ঘটিয়ে মানুষের সাথে নানা কাজে জড়ায়। পশুর খামারের পতাকায় আসে বদল, আগে তাতে অঙ্কিত থাকত সাদা শিং ও খুর, এখন পতাকার রং হয় শুধু সবুজ। পশু বিদ্রোহের আগে খামারের নাম ছিল ম্যানর ফার্ম, নেপোলিয়ন তার মানুষ বন্ধুদের স্বীকৃতি পেতে আবারো খামারের নাম ফিরিয়ে আনেন। অ্যানিম্যাল ফার্ম পুনরায় ম্যানর ফার্মে পরিণত হয়।

এরপর খামার বাড়ির কক্ষে পশুরা হইচই শুনে বিস্মিত হয়। ঠিক তেমনই, যেমন হইচই করত আগের মালিক, তাস খেলত বন্ধুদের নিয়ে, আর মদপান করে করত চিল্লাচিল্লি। পুরনো স্মৃতি তাদের মনে পড়ে। তারা খামার বাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। চুপিচুপি জানালার পাশে দাঁড়িয়ে দেখে, নেপোলিয়ন আর তার বন্ধু পিলিংটন তাস খেলাকে কেন্দ্র করে ঝগড়া করছে। কক্ষের ভেতর বারোটি কণ্ঠস্বর। কেউ কেউ মানুষ, কেউ কেউ শুয়োর। পশুরা শুয়োরদের চেহারার দিকে তাকাল আবার মানুষদের চেহারার দিকে। যে মানুষগুলো তাদের ওপর অত্যাচার করার কারণে পশুদের ঘৃণার অন্ত নেই, সেই মানুষের কবল থেকে মুক্তির জন্য শুয়োররা পশুরাষ্ট্র পরিচালনা করছে। কিন্তু পশুরা শোষক হিসেবে মানুষের চেহারা আর শুয়োরের চেহারার মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখতে পেল না।

এই যে চিত্র ও চরিত্র দেখলেন, বুঝতেই পারছেন, জর্জ অরওয়েলের অ্যানিম্যাল ফার্মকে আমরা দেখাচ্ছি। রাশিয়ার বিপ্লব পরবর্তী শাসক স্ট্যালিনের শাসনব্যবস্থা, তার প্রশাসন এবং তখনকার সামাজিক অবস্থাকে পশুখামারের প্রতীকে তিনি উপস্থাপন করেছেন। তার উপন্যাসের মূল সুর ছিল সমাজতন্ত্রের ব্যর্থতার চিত্রায়ন। কমিউনিস্ট বিপ্লবকে ব্যঙ্গ করেছে গোটা উপন্যাস। পশুদের বিপ্লবের আড়ালে হাজির করা হয়েছে লেনিনের নেতৃত্বে ১৯১৭ সালের বিপ্লবকে। যা বুড়ো মেজর তথা কার্লমার্ক্স বা লেনিনের স্বপ্নপূরণে মি. জোন্সের প্রতীকে প্রতিস্থাপিত জারতন্ত্রের অবশেষকে উচ্ছেদ করেছিল।

উপন্যাসের স্নোবল চরিত্র বিপ্লবের সংগঠক ট্রটস্কিকে প্রতিনিধিত্ব করে আর নেপোলিয়ন চরিত্রে উপস্থাপিত হন স্টালিন। যার দ্বারা ট্রটস্কি বিতাড়িত ও নিহত হন বিপ্লবের পরে। উদয়াস্ত খেটে চলা ঘোড়া বক্সার হলো রাশিয়ার শ্রমিক শ্রেণী এবং স্কুয়েলার হলো স্টালিনের অনুগত দাসানুদাস প্রচারমাধ্যম এবং বুদ্ধিজীবী শ্রেণী।

এ উপন্যাস লেখার ভাবনা অরওয়েলের মাথায় এসেছিল ১৯৩৭ সালের দিকে এবং ’৪৩-এর আগ পর্যন্ত এটা লিখতে পারেননি। বইটি প্রকাশিত হয় ১৯৪৫ সালে। বইটি লেখার পরে প্রকাশের জন্য অরওয়েল বেশ কয়েকজন প্রকাশকের সাথে যোগাযোগ করেন, কিন্তু তারা বিভিন্নভাবে তাকে ফিরিয়ে দেন। একজন রাজি হলেও প্রকাশ করবে কি না তা পরামর্শ করার জন্য তৎকালীন তথ্য মন্ত্রণালয়ের সাথে যোগাযোগ করেছিলেন। মোটাদাগে দুটো আপত্তির কথা জানানো হয়। এক. অ্যানিমেল ফার্ম স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা ও স্বৈরাচারদের নিয়ে লিখিত হলেও সোভিয়েত ও স্ট্যালিনের দিকে ইঙ্গিত একেবারে স্পষ্ট। তাই, ‘বর্তমান সময়ে’ এটা প্রকাশ করা অনুচিত। দুই. উপন্যাসে কর্তৃত্বপরায়ণ গোষ্ঠী হিসেবে শুয়োরদের দেখানো হয়েছে, এতে অনেকেই আঘাতপ্রাপ্ত হবেন, বিশেষ করে সোভিয়েতের শাসক সমাজ।

এই পুরো বিষয়টাকে অরওয়েল একটা খারাপ আলামত হিসেবে দেখেন। তিনি যখন লিখছেন তখন সরকারের সেন্সরশিপ তার চিন্তাকে বিচলিত করেনি, কারণ সে দৃশ্যমান এবং তাকে মোকাবেলার ভাষা স্পষ্ট। কিন্তু বইটির প্রকাশকে আটকে দিচ্ছিল প্রকাশক মহল। অতএব তিনি চিন্তিত হন সেই সঙ্কট নিয়ে, যা মিডিয়াপাড়া ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে বিদ্যমান। কোন লেখা প্রকাশযোগ্য ও কোনো লেখা প্রকাশযোগ্য নয়, তা নিয়ে এক ধরনের নীরব সম্মতি তৈরি করেন তারা। অ-জনপ্রিয় চিন্তাকে দমিয়ে রাখা এবং অস্বস্তিকর তথ্যকে লুকিয়ে ফেলার কাজে তারা সরকারের এমন সহযোগী, যারা মূলত ছদ্মবেশী। তাদের তৈরি ‘নীরব সম্মতি’ ঠিক করে দেয়, কোন ঘটনা লুকানো হবে আর কোন ঘটনা প্রকাশিত হবে। তারা কায়েমি স্বার্থের স্থির করে দেয়া ধ্যান-ধারণা-চিন্তা-ভাবনার বাইরে যেতে চান না। বস্তুত তারা দিন শেষে অ্যানিম্যাল ফার্মের সেই স্কুয়েলারের ভূমিকা পালন করেন।

আর এই জমানায়, নোয়াম চমস্কি দেখিয়েছেন, স্কুয়েলারের ভূমিকা আরো বিস্তৃতভাবে পালন করছে মিডিয়া। সম্মতি উৎপাদনে মিডিয়ার ভূমিকা নিয়ে বিস্তারিত ও বিস্তৃত আলাপ করে চমস্কি দেখান : কিভাবে হালজমানার রাষ্ট্র ও করপোরেশন নিজেদের স্বার্থের ভাষ্যকার হিসেবে মিডিয়াকে ব্যবহার করছে। এখন আর বানান করে বলে দিতে হয় না, নেপোলিয়নের সেই স্কুয়েলার হয়ে মিডিয়া কিভাবে কাজ করছে শোষক-নীপিড়ক শক্তির পাহারায়! এদের বিপরীতে স্বাধীনচিত্তের একজন বুদ্ধিজীবীর লড়াই তাই অনেক দুরূহ। তার শত্রুর শেষ নেই। একজন লেখক বা সাংবাদিককে যত ধরনের শত্রুর মোকাবেলা করতে হয়, বুদ্ধিবৃত্তিক কাপুরুষতা হচ্ছে সবচেয়ে খারাপ শত্রু। কিন্তু মুশকিল হলো এই ‘শত্রু’কে নিয়ে যতটা আলাপ-আলোচনা করা দরকার সেটাও করা হয় না।

অ্যানিম্যাল ফার্ম যদিও প্রথমত রুশ বিপ্লবের ওপর একটি ব্যঙ্গাত্মক রচনা, কিন্তু এর আবেদন ব্যাপক। বিপ্লব ও পরিবর্তনের বাহারি স্লোগান দিয়ে ক্ষমতালোভীরা আসলে বিপ্লব চায় না, চায় শুধু কর্তৃত্বের বদল। আদর্শ তাদের মুখ্য নয়, তাদের দরকার ক্ষমতা ও লালসাপূরণ। মানবতার পরম কাম্য সাম্যের দশা তাদের হাতে আরো লাঞ্ছনাকর অবস্থায় পতিত হয়। তারা নতুন বোতলে পুরনো মদই সরবরাহ করে মাত্র। এর মোকাবেলায় প্রতারিত না হওয়ার জন্য জনতার রাজনৈতিকতা, গণঐক্য, গণ অধিকারের গণপাহারা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে মিলিত সোচ্চারতার বিকল্প নেই।

জর্জ অরওয়েল অধিকারহারা শোষিত মানুষকে কৌতুকের ছলে পশু হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। তার উদ্দেশ্য মানুষকে অপমান করা নয়। এ গ্রন্থে তার নীতি হলো, ‘মানুষের মর্যাদাহানি করো না, তবে তাকে স্মরণ করিয়ে দাও ইতোমধ্যে তার মর্যাদাহানি ঘটেছে।’

লেখক : কবি, গবেষক 71.alhafij@gmail.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *