গভীর রাজনৈতিক সংকটে বাংলাদেশ

মতামত সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

শহীদুল্লাহ ফরায়জী

বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংকট বিরাজমান। এটা বাংলাদেশের জনগণ এবং আন্তর্জাতিক বিশ্বে প্রতিভাত হলেও সরকারের কাছে এই সংকট পরোয়া করার মতো নয়। কারণ সরকারের কাছে একমাত্র সংকট হচ্ছে ক্ষমতা ধরে রাখার সংকট। ফলে এই ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য জনগণ যদি সম্মতি বা সমর্থন দিতে না পারে না দিক, অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন না হোক শুধুমাত্র ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার স্বার্থে যা যা করণীয় ‘সরকার তাই করছে এবং করবে’।

গণতন্ত্র না থাক বা প্রজাতন্ত্রের চরিত্র খর্ব হয়ে যাক বা ভূরাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ুক, সহিংস পরিবেশ বিদ্যমান থাকুক এতে সরকারের বিন্দুমাত্র কিছু যায় আসে না। অসামান্য সংগ্রাম সমৃদ্ধ একটি দল আওয়ামী লীগ। কিন্তু আওয়ামী লীগ যে কারণে সংগ্রাম করেছে, যে সকল প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করে গণসমর্থন আদায় করেছে, যে সকল অঙ্গীকার ঘোষণা করে ক্ষমতায় আসীন হয়েছে সে সকল প্রতিশ্রুতি অস্বীকার করে নতুন এক আওয়ামী লীগ হিসেবে জাতির সামনে আবির্ভূত হয়েছে।

১৯৭২ সাল থেকে ৭৫ সাল এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিলুপ্ত করার পর আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক পদক্ষেপ পর্যালোচনা করাই এই নিবন্ধের প্রয়াস। আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগ নেতৃৃত্বের সমস্ত সংগ্রাম ভোটাধিকার, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। ১৯৭২ সালের সংবিধানে আইনের শাসন, আইনের শ্রেষ্ঠত্ব, আইনের চোখে সমতা সব উল্লেখ আছে। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনা করতে গিয়ে নিবর্তনমূলক আইন জরুরি অবস্থা জারির জন্য ১৯৭৩ সালেই গণতান্ত্রিক সংবিধানের চরিত্র বদল করার উদ্যোগ নেয়া হয় দ্বিতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে।

ফলে সংবিধান মৌলিক অধিকারের অঙ্গীকার থেকে সুস্পষ্টভাবে সরে আসে এবং সংবিধানের আধিপত্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। এই সংশোধনীতে জরুরি অবস্থা ঘোষণার ব্যবস্থা সংবলিত ১৪১ (ক) অনুচ্ছেদ যুক্ত করা হয়। এর মাধ্যমে সংবিধানে মৌলিক অধিকার পরিপন্থি আইন বিশেষ করে উচ্চ আদালতের ক্ষমতা সংকুচিত হয়ে পড়ে এবং জনগণের মৌলিক মানবাধিকার স্থগিত রাখার সুযোগ সৃষ্টি হয়।

সংসদীয় ব্যবস্থায় সকল বিরোধী দলের অংশগ্রহণে ৭৩ সালে নির্বাচনের পর চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে একদলীয় শাসনব্যবস্থা চালু করা হয়। ১৯৭৫ সালের ২৫শে জানুয়ারি চতুর্থ সংশোধনী পাস হয়, যার মাধ্যমে ’৭২ সালের সংবিধানের মৌলিক কাঠামো ধ্বংস করা হয়। চতুর্থ সংশোধনী জাতীয় রাজনীতিতে কী প্রভাব ফেলেছে, জাতীয় রাজনীতির গতিপথ কীভাবে পরিবর্তিত হয়েছে- তা বলার জন্য বড় পরিসর প্রয়োজন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর আওয়ামী লীগ নেতারাই নতুন মন্ত্রিসভায় যোগ দেন।

বর্তমানে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের সকল রাজনৈতিক দল, সমাজের বিভিন্ন অংশ এমনকি আন্তর্জাতিক বিশ্ব যতই ঘনীভূত সংকটের কথা বলুক তা আওয়ামী লীগ বিবেচনায় নেওয়ার প্রয়োজনবোধ করবে না। ক্ষমতা ধরে রাখতে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো আইনগত এবং নৈতিকভাবে ধ্বংস করা হয়েছে তা আর আলোচনার বিষয়বস্তু নয়।

শুধু ভোটাধিকারের দাবিতে কী প্রচুর পরিমাণ রক্ত ঝরেছে, নির্যাতনের শিকার হয়েছে, রাজনৈতিক নেতাকর্মীদেরকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়েছে তার কোনো হিসাব রাষ্ট্র দিতে পারবে না। কিন্তু তবুও এই ইস্যুটাকে সরকার বিবেচনাযোগ্যই মনে করছে না। ১৫৩ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এবং রাতের ভোট এই দুটোকেই আওয়ামী লীগ আত্মতৃপ্তি সহকারে গ্রহণ করেছে; বরং আওয়ামী লীগ গণতন্ত্র সুরক্ষা দিয়েছে, জনগণের হাতে ভোট ফিরিয়ে দিয়েছে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলেই ভোট নিরপেক্ষ হয়, জনগণ ভোট দিতে পারে অহরহ বয়ান দিয়ে যাচ্ছে। এসব বিষয়ে আওয়ামী লীগ কোনো অনুতপ্ত হয় না আর অনুতপ্ত কোনোদিন হবেও না।

আওয়ামী লীগ আর অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের আয়োজন করতে পারবে না। কারণ আওয়ামী লীগের নৈতিকতায় নির্বাচনের নামে প্রহসন গ্রথিত হয়ে গেছে। ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় আওয়ামী লীগ আর গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিনির্মাণ করতে পারবে না। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে সাংবিধানিক রাজনীতির প্রতি কখনো প্রতিশ্রুতিশীল নয়, বিরোধী দলে থাকলে গণতন্ত্র আইনের শাসন ভোটাধিকার ও মানবাধিকার সুরক্ষার প্রশ্নে আওয়ামী লীগ আপসহীন। বিরোধী দলে থাকলে যে কারণে রক্ত দেয়, ক্ষমতায় থাকলে একই কারণে রক্ত নেয়। আওয়ামী লীগের এই দ্বৈত চরিত্র রাষ্ট্রকে খাদের কিনারে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।

একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ন্যূনতম বৈশিষ্ট্য অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন- তাও এখানে অনুপস্থিত। দেশে শক্তিশালী গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, স্বাধীন বিচার বিভাগ বা শক্তিশালী গণমাধ্যম কোনোটাই বিরাজমান নেই। যে সকল সিন্ডিকেট দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে জনদুর্ভোগ বাড়িয়ে দিচ্ছে তারাই রাষ্ট্রের সুরক্ষা পাচ্ছে। জনগণ অর্থাৎ শ্রমিক ও কৃষক রাষ্ট্রের কাছে অপাংতেয় হয়ে পড়েছে। ক্ষুধার্ত মানুষ রাস্তায় নামলে, মজুরির দাবিতে রাজপথে শ্রমিক নামলে ভাগ্যে গুলি অবধারিত। অধিকার আদায়ে মানুষ রাস্তায় থাকবে আর রাষ্ট্র মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রায় ক্রয়কৃত অস্ত্র ব্যবহার করবে না, এতে মনে হয় রাষ্ট্রের কৃতিত্ব হুমকির মুখে পড়ে যায়। সুতরাং গুলি বা নির্যাতন এটা জনগণের নিয়তি।

বিরোধী নেতাকর্মীদের নামে গায়েবি মামলা দিয়ে, বলপ্রয়োগ জারি রেখে, নিপীড়ন নির্যাতনের স্টিমরোলার চালিয়ে ক্ষমতা ধরে রাখার পণ থেকে আওয়ামী লীগের সরে যাওয়ার কোনো ভাবনা নেই। আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করে সবাই ভুল করে তারা কোনো ভুল করে না। আরও বিশ্বাস করে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রে তারাই ক্ষমতায় থাকার একমাত্র চিরস্থায়ী বৈধ উত্তরাধিকার। তাই একটা ঘটনাকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে নির্বাচনের পূর্বে বিরোধী দলের নেতাকর্মী গ্রেপ্তার করে ফাঁকা মাঠে গোল দেয়ার আয়োজন সরকার করবেই। বিরোধী দলের সমাবেশের দিন সরকারি দলের সমাবেশ ডেকে সংঘাতের উস্কানি দেয়া আওয়ামী লীগের পক্ষে সম্ভব, বিশ্বের কোনো গণতান্ত্রিক দেশে এটা চিন্তাও করা যায় না। শুধু সরকার বিরোধিতার কারণে নাশকতার নামে অগণিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে অমানবিক অবমাননাকর শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে।

রাষ্ট্র ভূরাজনীতিতে বা বৈশ্বিক বাণিজ্যে প্রতিকূলতায় পড়ুক, শিল্পকারখানা বন্ধ হোক, আমদানি-রপ্তানিতে প্রভাব পড়ুক এসব অগুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচনায় নিচ্ছে সরকার। এর প্রতিক্রিয়া অবশ্যম্ভাবী। পুলিশ হত্যা দুঃখজনক, কিন্তু মানুষ হত্যাও অন্যায়। রাজপথ মানুষের রক্ত রঞ্জিত হবে অথচ রাষ্ট্রে একটা তদন্ত হবে না, সেটাকে রাষ্ট্র বলা যায় না। প্রতিপক্ষের ওপর বল প্রয়োগ করা যায়, বিনা বিচারে হত্যা করা যায়, কারাগারে প্রেরণ করা যায়, নিষ্ঠুর নির্যাতন করা যায়, এই রাষ্ট্রের জন্য মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়নি।

শুধুমাত্র একটা অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের আয়োজন না করে রাষ্ট্রকে ব্যর্থ রাষ্ট্রের অতল গহ্বরের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, রাষ্ট্রকে চরম বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে তা আওয়ামী লীগ বুঝতে অক্ষম। বহুদলীয় গণতন্ত্রের দেশে একদল, ভোটের প্রতিযোগিতাকে নির্বাসনে দিয়ে রাতে ভোট কীভাবে সম্পন্ন হলো তার উত্তর কোনোদিন আওয়ামী লীগ দেবে না। আওয়ামী লীগ কোনোদিন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলবে না যেখানে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত হয়, জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। বিচার বিভাগ যখনই ন্যূনতম স্বাধীন ভূমিকা রেখেছে তখনই তা আওয়ামী লীগের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু পরিণত হয়েছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতা রক্ষার স্বার্থেই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি ন্যূনতম শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে কোনো সমঝোতা করতে পারবে না। নির্বাচনী প্রতিযোগিতা কষ্টকর ও দূরূহ। ফলে নির্বাচনী প্রতিযোগিতা আওয়ামী লীগের কাছে অপ্রয়োজন হয়ে পড়েছে। ফলে অনির্বাচিত হয়েও ক্ষমতায় থাকার সুযোগ হাতছাড়া করছে না সরকার। অনির্বাচিত সরকারকে রাষ্ট্রীয় কোনো প্রতিষ্ঠান দ্বারা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে না।

ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলে আদালতের রায়ের অজুহাতে জাতির প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার না দিয়ে সরকার কর্তৃক সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও অস্তিত্বকে বিপজ্জনক পর্যায়ে নিয়ে গেছে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের ‘সাম্য’ ‘মানবিক মর্যাদা’ ও ‘সামাজিক সুবিচার’ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে পরিত্যক্ত হয়ে পড়েছে।

গায়েবি মামলা দিয়ে যে রাষ্ট্রে নাগরিকদের নির্বিচারে গ্রেপ্তার করা যায়, রিমান্ডে নেয়া যায় আদালতে দণ্ডিত করা যায়, ব্যক্তিগত ফোন তল্লাশি করা যায়, যাপিত জীবন নজরদারির আওতায় আনা যায়, যেখানে জনগণের সম্মতি ছাড়াই ক্ষমতায় থাকা যায়, আইনের শাসন যেখানে বিপন্ন, শক্তি প্রয়োগে যেখানে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান অনুসন্ধান করা হয় সেটা আইনের দৃষ্টিতে ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
রাষ্ট্রের সঙ্গে জনগণের চুক্তি এবং প্রতিশ্রুতি যথাযথভাবে মান্য করা, আত্মরক্ষা ছাড়া অন্য কোনো কারণে শক্তির ব্যবহার না করা এবং মানবাধিকারের প্রতি সশ্রদ্ধ অবস্থান রক্ষা করা থেকে যে সকল রাষ্ট্র বিরত থাকে তাদেরকেই আইন অমান্যকারী রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করার কথা বলেছেন দার্শনিক জন রলজ।

বাংলাদেশ অনেকদিন ধরেই সুপরিকল্পিতভাবে সংবিধান এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা উপেক্ষা করে গভীর সংকটের দিকে অভিযাত্রা শুরু করেছে।

লেখক : গীতিকবি faraizees@gmail.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *