একটি দেশের টিকসই গণতন্ত্র, স্থিতিশীল অর্থনীতি, জাতীয় সমৃদ্বি, সামাজিক সম্প্রীতি এবং শান্তি শৃংখলা নির্ভর করে সে দেশে কতটুকু আইনের শাসন কার্যকর আছে তার উপর। বিচার, বিচারক এবং বিচার ব্যবস্থা এ তিনটি হচ্ছে আইনের শাসনের মূল ভিত্তি। আইনের শাসন সম্পর্কে শাসক ও শাসিতের স্বচ্ছ ও সঠিক জ্ঞান এবং বুঝও আইনের শাসনের কার্যকারিতার জন্য একটি অপরিহার্য উপাদান।
যে দেশে বা যে সমাজে আইনের শাসন নেই সে সমাজে দুর্বৃত্তদের শাসন কায়েম হয়। ফলে সমাজে অসৎ, লম্পট, সন্ত্রাসী, স্বৈরাচারী, জালিম, দূর্নীতিবাজ ও দেশদ্রোহীদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। তারা ধরাকে সরা জ্ঞান করে, সমাজের রন্দ্রে রন্দ্রে অন্যায়, জুলুম, দূর্নীতি ও সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। ফলে মিথ্যাচার, দূর্নীতি, জুলুম, নির্যাতন, নীপিড়ন ও সৎ লোকের অসহায়ত্ব সমাজের স্বাভাবিক জীবনাচারে পরিণত হয়। অপরাধী ও নীতিহীন লোক বিচারক হয়, স্বৈরাচারী ও দুর্নীতিবাজদের লালন ও নিরাপত্তা বিধান হয় বিচার নীতি, বিচারালয় হয় অসৎ, দুর্নীতিবাজ ও সন্ত্রাসীদের লালন কেন্দ্র, বিচার ব্যবস্থা হয় স্বৈরাচার ও দুর্বৃত্তদের অপকর্মের বিধায়ক আর দুষ্টের লালন ও শিষ্টের দমন হয় বিচার ব্যবস্থার অন্যতম প্রধান নীতি।
এ অবস্থা দীর্ঘদিন চলতে থাকলে সমাজে অন্ধকার তীব্রতর হতে থাকে, নিষ্পেষিতদের মনের হতাশা প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের বারুদে রূপান্তরিত হয়, যে বারুদ অগ্নি শিখা হয়ে জালিম শাহীর পতন ঘটায়। বাংলাদেশে ১৭ই জুলাই থেকে ৫ আগষ্ট ২০২৪ পর্যন্ত যা হয়েছে সেটাই তারই বাস্তব উদাহরন।
বিপ্লবীদের মনে রাখতে হবে, স্বৈরাচারের পতন হয়েছে কিন্তু বিপ্লব এখনও সফল হয়নি। বিপ্লব সেদিনই সফল হবে যেদিন দেশের সর্বত্র আইনের শাসন কায়েম হবে, মানবীয় মূল্যবোধ উজ্জীবিত হবে এবং স্বৈরাচারী শক্তি রাষ্ট্র ক্ষমতায় ফিরে আসার সকল পথ রুদ্ধ হবে। জাতীয় জীবনের সকল ক্ষেত্রে সত্যিকারের আইনের শাসন সুপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই তা নিশ্চিত করা সম্ভব হতে পারে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে আইনের শাসন কি এবং তার বৈশিষ্ট্যগুলো কি?
আইনের শাসন মানে কোন ব্যক্তি বা দলের মর্জিতে নয় আইনের ভিত্তিতেই দেশ এবং দেশের প্রতিটি অংগ এবং নাগরিক পরিচালিত হবে। দেশের শাসক, শাসিত এবং শাসন কাজে নিয়োজিত প্রতিটি প্রতিষ্ঠান আইনের কাছে দায়বদ্ব থাকবে। আইনের প্রতি রাষ্ট্রের প্রতিটি অংগ এবং জনগণ শ্রদ্ধাশীল থাকবে। কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। প্রত্যেক ব্যক্তি বা নাগরিক, তাঁর সামাজিক বা রাজনৈতিক অবস্থান যাই হউক না কেন, তিনি দেশে প্রচলিত আইনের আওতায় থাকবেন। আইন প্রয়োগকারী যেমন আইনের বাস্তবায়নে কারো চাপের মূখোমুখি হওয়ার ভয় করবেনা, তেমনি আইনগত অধিকার ভোগ করার ক্ষেত্রে কোন প্রকার বন্চনার শিকার হওয়ার আশংকা করবেনা।
আইনের শাসনের বৈশিষ্টগুলো নিম্নরূপ:
১. জবাবদীহিতা: সরকারী প্রতিটি বিভাগ আইনের কাছে জবাবদিহিতার অনুভূতি নিয়ে আইনের চৌহদ্দির মধ্যে থেকেই কাজ করবে।
২. ন্যায় বিচার ও সমান অধিকা: দেশের প্রতিটি নাগরিক (রাষ্ট্র ও সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে) নাগরিক হিসেবে ন্যায় বিচার ও সমান অধিকার ভোগ করবে।
৩. স্বচ্ছতা: আইনের বিধান রচনা ও প্রয়োগে পূর্ণ স্বচ্ছতা থাকবে। আইন ও আইনের প্রয়োগ সম্পর্কে প্রতিটি নাগরিককে পূর্ণ অবহিত করার রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা থাকবে।
৪. বিচার বিভাগের স্বাধীনতা: বিচার বিভাগ পূর্ণ স্বাধীনভাবে কাজ করবে এবং বিচারক ও বিচার কার্যের উপর শাসন বিভাগের কোন প্রকার কর্তৃত্ব থাকবেন। আদালত কোন প্রকার ভয় ছাড়া ন্যায় বিচার নিশ্চিত করবে।
৫. ন্যায় বিচার পাওয়ার অধিকার: ধনি গরীব নির্বিশেষে সকল রাষ্ট্রের সকল নাগরিক ও প্রতিষ্ঠানের আইনগত সহায়তা ও ন্যায় বিচার পাওয়ার অধিকারের নিশ্চয়তা থাকবে।
৬. মানবাধিকারের নিশ্চয়তা বিধান: রাষ্ট্র প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক মানবাধিকারের নিশ্চয়তা বিধান করবে। প্রতিটি নাগরিক নির্ভয়ে ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও বাক স্বাধীনতা প্রয়োগ করতে কোন বাঁধার সম্মুখীন হবেনা।
৭. সংবিধান এবং মানবিক নৈতিক মূল্যবোধ: দেশের সংবিধান এবং মানবিক ও নাতিক মূল্যবোধের সংরক্ষন আইনের অন্যতম লক্ষ্য্য।
মূলতঃ আইনের শাসন হচ্ছে একটি স্বচ্ছ, শান্তিপূর্ণ, ন্যায়ভিত্তিক ও গতিশীল সমাজের মূল ভিত্তি। আইনের শাসন একটি দেশ ও জাতিকে উত্তরোত্তর উন্নতির দিকে নিয়ে যেতে সহায়তা করে। যে দেশ বা সমাজে আইনের শাসন নেই সেই দেশ বা সমাজে শান্তি ও স্থিতিশীলতা আশা করা যায়না। যেখানে আইনের শাসন নেই সেখানে জুলুম ও স্বৈরাচার মাথাচড়া দিয়ে উঠে। আইনের শাসনের মূল প্রতিপাদ্য উপাদান হচ্ছে বিচার, বিচারক এবং বিচার ব্যবস্থা। এই তিনটি উপাদান যদি সঠিকভাবে, স্বচ্ছতার সহিত কাজ করে তাহলেই দেশে আইনের শাসন কায়েম হবে।
বিচার:
বিচার মানে ন্যায় ও সত্যের মাপকাঠি। অন্য কথায় বলা যায়, কোনটা ন্যায়, কোনটা অন্যায়, কোনটা শাসন, কোনটা অপশাসন বা জুলুম তা নির্ধারনের মাপকাঠি বা বাহন হচ্ছে বিচার। বিচার অনেক সময় ইনসাফ বা ন্যায়নিষ্ঠতা অর্থেও ব্যবহার হয়। আইনের শাসনের প্রধান উপাদান হচ্ছে ন্যায়বিচার। বিচারে নিরপেক্ষতা ও স্বচ্ছতা বিচারের প্রতি মানুষের আস্থা প্রতিষ্ঠার অন্যতম পূর্বশর্ত। বিচার যদি পক্ষপাতদুষ্ট ও অস্বচ্ছ হয় তাহলে বিচারের প্রতি মানুষের আস্থা ও নির্ভরশীলতা কখনই প্রতিষ্ঠিত হবেনা। ফলে মানুষ, বিশেষতঃ অপরাধীরা আইন বা বিচারের তোয়াক্কা করবেনা, জুলুম ও অপরাধ প্রবণতা তিলে তিলে বৃদ্ধি পাবে এবং আইনের শাসন কখনও প্রতিষ্ঠিত হবেনা। এ জন্যে মহান আল্লাহ সামাজিক শান্তির উৎস হিসেবে সুবিচার প্রতিষ্ঠার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেল এবং সুবিচারকারীর প্রতি তাঁর ভালোবাসার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। মহান আল্লাহ বলেনঃ “তাদের মধ্যে ইনসাফের সঙ্গে ফয়সালা কর আর সুবিচার কর; আল্লাহ সুবিচারকারীদেরকে ভালোবাসেন।” [সুরা হুজুরাত, ৯]
অপরদিকে অন্যায় তথা অবিচার না করার তাগিদ দিয়ে অন্যায়কে যমীনে বিপর্যয়ের কারন হিসেবে অবিহিত করেছেনঃ “হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা ন্যায়সঙ্গতভাবে মাপো ও ওজন করো, লোকদেরকে তাদের প্রাপ্য বস্তু কম দিও না এবং যমীনে বিপর্যয় সৃষ্টি করে বেড়িও না।” [সুরা হুদ ৮৫),
অতএব, বিপর্যয়মুক্ত একটি শান্তিময় সমাজ কায়েমের জন্য বিচারের ক্ষেত্রে ন্যায় নিষ্ঠতার নিশ্চয়তা বিধান অপরিহার্য।
বিচারক:
বিচারক হচ্ছে আইনের শাসনের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। কোন আদালতের বিচারক যদি ন্যায়নিষ্ঠ, সৎ, যোগ্য, প্রজ্ঞাবান, মুত্তাকি তথা খেদাভিরু (মুসলমানের ক্ষেত্রে) হয়, এবং মানবিক মূল্যবোধে উজ্জীবিত হয়, তাহলে সেই আদালত থেকে ন্যায় বিচার আশা করা যায়। অপরদিকে কোন আদালতের বিচারক যদি অসৎ, লোভী, নীতি-নৈতিকতাহীন, অদক্ষ ও দুর্নীতিবাজ হয় তাহলে সে আদালত থেকে কখনও ন্যায় বিচার তথা ইনসাফ আশা করা যায়না। আর যে সমাজ ইনসাফ থেকে বঞ্চিত হয় সে সমাজে কখনও শান্তি এবং আইনের শাসন আশা করা যায়না।
এ জন্য যেকোন সমাজে বিচারকের বিশেষ মর্যাদা নিশ্চিত করা হয়েছে। ইসলাম ন্যায়নিষ্ঠ বিচারকের অনন্য মর্যাদা দান করেছে। কেননা ন্যায়নিষ্ঠ বিচারক সমাজে অবিচারের পরিবর্তে সুবিচার, অপরাধের পরিবর্তে শৃঙ্খলা, অন্যায়ের পরিবর্তে ন্যায়, মন্দের পরিবর্তে ভালো প্রতিষ্ঠার কাজে নিয়োজিত।
একজন ন্যায়নিষ্ট বিচারক ভুল করলেও তাঁর সততা ও আন্তরিক চেষ্টার বদৌলতে প্রতিদান পাওয়ার যোগ্য : রাসুলুল্লাহ (সা.) ন্যায় অনুসন্ধানী বিচারকের জন্য ভুল ও সঠিক উভয় সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে প্রতিদান ঘোষণা করেছেন। বিচার কার্য নবী-রাসুলগনের নবুয়্যতি দায়িত্বের অংশ ছিল। পবিত্র কোরআনের একাধিক আয়াত থেকে নবী-রাসুলদের বিচারকাজে আত্মনিয়োগের প্রমাণ পাওয়া যায়। যেমন—আল্লাহ বলেন, ‘হে দাউদ! নিশ্চয়ই আমি তোমাকে পৃথিবীতে প্রতিনিধি নিযুক্ত করেছি। সুতরাং তুমি মানুষের মধ্যে যথাযথভাবে বিচার কোরো।’ (সুরা : সোয়াদ, আয়াত : ২৬) শুধু তাই নয় ন্যায়নিষ্ঠ বিচারকদের প্রতি আল্লাহ তাঁর ভালোবাসার ঘোষণা দিয়েছেন। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেনঃ, ‘যখন তুমি বিচার করো, তখন তাদের মধ্যে ন্যায়ের সঙ্গে ফায়সালা করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ ন্যায়নিষ্ঠদের ভালোবাসেন।’ (সুরা মায়েদা, আয়াত : ৫)
তাই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে বিচারক নিয়োগ ও ব্যাবস্থাপনার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে বিচারক নিয়েগের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা এবং বিচারকের মৌলিক যোগ্যতা ও দক্ষতা নিশ্চিত করা একান্ত আবশ্যক। এক্ষেত্রে নিয়োগকালে নিন্নোক্ত মৌলিক গুনাবলীর ব্যপারে আপোষহীন হতে হবে।
• সততা: যিনি বিচারক হবেন তাঁকে সততার পরীক্ষায় প্রশ্নহীন ভাবে উত্তীর্ণ হতে হবে।
• নিরপেক্ষতাঃ বিচারককে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ মনের অধিকারী হতে হবে। তিনি যেন ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দের দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে বিচার করেন তার নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে।
• বিচারক সুলভ মনোভঙ্গিঃ একজন বিচারকের জন্য বিচারক সুলভ মনোভঙ্গির অধিকারী হওয়া খুবই জরুরী। তিনি কখনই মেজাজী হলে চলবেনা। তাই বিচারক নিয়োগকালে ব্যক্তি সকল অবস্থায় মামলার সকল পক্ষের সাথে শান্ত মেজাজ বজায় রেখে ব্যবহার করার যোগ্যতা রাখেন কিনা তা নিশ্চিত করা একান্ত আবশ্যক।
• বুদ্ধিমত্তা: একজন বিচারকের মামলার সমসাময়িক পরিবেশ পরিস্থিতি অনুধাবন করার মত বুদ্ধিবৃত্তিক যোগ্যতা থাকা জরুরী। তাঁকে প্রেক্ষাপটের ভিন্নতা যাচাই করে আইনের সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে যথাযথ সিদ্বান্ত নেওয়ার সক্ষমতা থাকতে হবে, যা বিচারক নিয়োগকাল অবশ্যই বিবেচনায় আনতে হবে।
• আইনের সাম্যক জ্ঞান ও প্রজ্ঞা: আইন ও তার নীতি এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগ সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানের অধিকারী হওয়া একজন বিচারকের অপরিহার্য গুণ। এজন্য বিচারক নিয়োগকালে আইন সম্পর্কে তাঁর জ্ঞানের পকিধি এবং জ্ঞানার্জনের প্রতি তাঁর সঠিক মনোভঙ্গি আছে কিনা তা নিয়োগকালেই নিশ্চিত করতে হবে। নিয়োগের পর যথাযথ প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য প্রস্তুত আছে কিনা তাও যাচাই করা আবশ্যক।
• সাহস ও ব্যক্তিত্ব: একজন বিচারপতিকে জালিমের বিরুদ্ধে ও মজলুমের পক্ষে রায় দিতে হয়। শাসক জালিম হলে অনেক সময় শাসকের বিরুদ্ধেও রায় দিতে। অদম্য সাহস না থাকলে এসব পরিস্থিতে ন্যায় বিচার করা দুরূহ। তাই বিচারক নিয়োগকালে ব্যক্তির সাহস ও ব্যক্তিত্বের প্রতি নজর দেওয়া আবশ্যক।
• বুঝা ও বুঝানোর দক্ষতা: একজন বিচারকের জন্য বিচার্য বিষয় এবং মামলার পরিস্থিতি সঠিকভাবে অনুধাবন করে যথার্থ রায় প্রদানের জন্য একান্ত আবশ্যক। তাই এক্ষেত্রে দক্ষতা থাকা একজন বিচারকের জন্য অত্যন্ত জরুরী।
• পেশাদারিত্ব: পেশাদারিত্ব আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল একজন বিচারকের অন্যতম গুণ বা বৈশিষ্ট্য। তাই বিচারক নিয়োগকালে পেশাদারিত্ব বজায় রাখার ক্ষেত্রে প্রার্থীর অংগীকার কতটুকু মজবুত তা যাচাই করা আবশ্যক।
• শারিরীক ও মানসিক সক্ষমতা: যথাসময়ে বিচার কার্য সম্পাদনের শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতা একজন বিচারকের অপরিহার্য গুণ। বিচারক নিয়োগকালে এ বিষয়ে নজর দেওয়া একান্ত আবশ্যক।
• জবাবদিহিতার অনুভূতি: জবাবদিহিতার অনুভূতি এবং পরকালের ভয় একজন বিচারককে ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকতে সাহায্য করে। তাই বিচারক নিয়োগকালে এ গুনের প্রতি সাম্যক গুরুত্ব দেওয়া আবশ্যক।
বিচার ব্যবস্থা:
ন্যায়বিচার ও ন্যায়পরায়ন বিচারক নিয়োগে এবং ব্যবস্থাপনা নির্ভর করে একটি স্বচ্ছ, টেকসই ও কার্যকর বিচার ব্যবস্থার উপর। বিচার ব্যবস্থা দূর্বল হলে সৎ ও দক্ষ বিচারক এবং সুষ্ঠু ও ন্যায় বিচার কামনা একটি দিবা স্বপ্ন ছাড়া আর কিছু নয়।
তাই একটি সভ্য, সুশৃংখল, নিরাপদ ও গতিশীল সমাজের জন্য একটি কার্যকর ও ন্যায়সঙ্গত বিচার ব্যবস্থা থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ ধরনের বিচার ব্যবস্থা কেমন হওয়া উচিত তা নিচে উল্লেখ করা হলো:
১. স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা: বিচার ব্যবস্থাকে রাজনৈতিক বা অন্যান্য প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে হবে, যাতে ন্যায়বিচার প্রভাবিত না হয়। বিচারকরা তাদের কাজ স্বাধীনভাবে করতে পারেন এবং কোনো পক্ষপাতিত্ব ছাড়াই ন্যায়বিচার প্রদান করতে পারেন। এজন্য বিচার বিভাগকে অবশ্যই executive বিভাগ থেকে আলাদা ও স্বাধীন রাখতে হবে।
২. স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা: বিচার ব্যবস্থা স্বচ্ছ হতে হবে, যাতে জনগণ তার কার্যপ্রণালী সম্পর্কে জানতে পারে এবং এটি বিশ্বাসযোগ্য হয়। পাশাপাশি, বিচারকদের ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের যথাযথ জবাবদিহিতাও থাকতে হবে।
৩. দ্রুত বিচার প্রক্রিয়া: দীর্ঘসূত্রতা বিচার ব্যবস্থাকে ব্যাহত করে। দ্রুত ও কার্যকরভাবে বিচার সম্পন্ন করতে হবে, যাতে বিচারের অপেক্ষায় থাকা মানুষ সময়মতো সঠিক বিচার পায়।
৪. ন্যায়বিচার ও মানবাধিকার: সকলের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে এবং কোনো বৈষম্য বা মানবাধিকার লঙ্ঘন যাতে না ঘটে তা নিশ্চিত করতে হবে। আইন সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য হতে হবে।
৫. অর্থনৈতিক সহায়তা ও অ্যাক্সেসিবিলিটি: দরিদ্র এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠী যাতে আইনি সহায়তা পায়, সে ব্যবস্থা থাকতে হবে। সকলের জন্য আইনগত সহায়তা সহজলভ্য ও গ্রহণযোগ্য হওয়া উচিত।
৬. আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার: প্রযুক্তির মাধ্যমে বিচার ব্যবস্থাকে আরও গতিশীল ও কার্যকর করা সম্ভব। ডিজিটাল রেকর্ডস, ভিডিও কনফারেন্সিং, এবং অনলাইন মামলার তথ্য ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা গড়ে তোলা উচিত।
৭. জনগণের আস্থা অর্জন: একটি সভ্য সমাজের বিচার ব্যবস্থাকে জনগণের আস্থা অর্জন করতে হবে। এতে করে সমাজে ন্যায় ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সহজ হবে।
এভাবে একটি সুষ্ঠু ও প্রগতিশীল বিচার ব্যবস্থা সভ্য সমাজে সুবিচার ও মানবাধিকার নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বিচার, বিচারক ও বিচার ব্যবস্থা যদি স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও দক্ষ হয় তাহলে একটি দেশ শান্তিময় ও স্থিতিশীল হবে, অর্থনীতির চাকা গতিমান থাকবে, মেধার বিকাশ হবে, সভ্যতা জীবন পাবে আর মানবতার জয়ধ্বনিতে জনপদ উল্লসিত হবে। সবশেষে এরিস্টটলের সাথে সুর মিলিয়ে বলতে চাই, “It is better for the law to rule than one of the citizens, ….. even guardians of the laws obeying the laws”. আইনের শাসনই জনগনের শাসন নিশ্চিত করে স্বৈরতন্ত্রের উথান ঠেকাতে পারে।
* ব্যারিস্টার হামিদ হোসাইন আজাদ এমসিএ’র কেন্দ্রীয় প্রেসিডেন্ট, খ্যাতিমান আইনজীবী ও মানবাধিকার ব্যক্তিত্ব