একটা সময় ছিলো যখন উপমহাদেশে ভিনদেশী বণিকগোষ্ঠী আসতো ব্যবসার উদ্দেশ্যে। পরে এই অঞ্চলে ব্যবসার প্রসার ও বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেখে পরে তারা আস্তে আস্তে নিজেদের শক্ত একটি অবস্থান করে নেয়। একপর্যায়ে নিজেদের সেই অবস্থানটি ধরে রাখতে তারা সাধারন মানুষসহ শাষকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। শুরু করে অন্যায়, অবিচার ও অত্যাচার। বিদেশী এই বণিকগোষ্ঠীর মধ্যে অন্যতম ছিলো ইংরেজ, পর্তুগীজ, ফরাসী, ডাচ ও ওলোন্দাজ’রা। কালের আবর্তে এসে একসময় সেই বণিকগোষ্ঠী উপমহাদেশ থেকে বিতাড়িত হতেও বাধ্য হয়েছে।
আধুনিক যুগে এসে বিশ্ব যখন সবার কাছে উন্মুক্ত হতে শুরু করেছে, তখন উপমহাদেশের জনগোষ্ঠীরাও বিভিন্ন দেশে ব্যবসা ও চাকুরীর উদ্দেশ্যে পাড়ি দিতে থাকেন। কয়েকশ বছর আগে যারা এই অঞ্চল শাষন করতেন, তাদের দেশেই এখন বাংলাদেশীরা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজের সাথে জড়িত রয়েছেন। শুধু তাই নয়, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদের দায়িত্বে থেকে তাদেরই শাষন করছেন বাংলাদেশীরা। তেমনি একজন হলেন পর্তুগালের লিসবনের অধিবাসী রানা তাসলিম উদ্দিন। তিনি লিসবনের সাবেক নির্বাচিত কাউন্সিলর। কাউন্সিলর হিসেবে তিনি সর্বপ্রথম বাংলাদেশী নয়, সর্বপ্রথম এশিয় বিদেশীও বটে।
দেশে-বিদেশে সবখানেই বাংলাদেশীদের প্রিয়মুখ রানা তাসলিম উদ্দিন। কারন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক, অর্থনৈকসহ সর্বস্তরেই তার সরব পদচারনা লক্ষণীয়। মোট ৬টি ভাষা জানা রানা তাসলিম এ পর্যন্ত পৃথিবীর প্রায় ৪২টির মত দেশ ঘুরেছেন। ভালো লাগে তার বিভিন্ন দেশ ও স্থান ঘুরে বেড়াতে, লিখালিখি করতে ও পড়তে। দেশ-বিদেশের গণমাধ্যমেও এক পরিচিত নামা রানা তাসলিম উদ্দিন। আশির দশকের শেষের দিকে দেশ ছেড়ে সুদূর পর্তুগালের বাসিন্দা হলেও বছরের বিভিন্ন সময়ে তিনি নিজ মাতৃভূমি বাংলাদেশে চলে আসেন নাড়ীর টানে।
দেশে অবস্থানকালেও সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকেন আড্ডা, ভ্রমণ ও বিভিন্ন সামাজিক কর্মকান্ডের সাথে। চিরসবুজ ও সৃজনশীল এই মানুষটি বাংলাদেশে অবস্থানকালে ‘দৈনিক সময়’র সঙ্গে আড্ডা দিয়েছেন। আড্ডার চুম্বক অংশ তুলে ধরেছেন ফাহিম ফয়সাল।
রানা তাসলিম ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করে দেশ ত্যাগ করেন। তিনি প্রথমে হংকং এ যান। সে সময়ে তাঁর কাছে ছিলো তৎকালিন সময়ের ৫০০ ডলার। এই বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমি ও আমার এক বন্ধু হংকং এয়ারপোর্টে নামি। সেখানে বিদেশ থেকে আগত কারো যদি পাসপোর্টে ভিসা না থকতো তাহেল তাঁকে এয়ারপোর্টে একটি ইন্টারভিউ দিতে হত। ইন্টারভিউতে আমি টিকে তিন মাসের ভিসা পেলেও আমার বন্ধুটিকে তখন দেশে ফেরত আসতে হয়। সেখানে তখন আমি সম্পূর্ণ বেকার জীবন যাপন করি। ভিসা শেষ হওয়ার মাত্র বিশদিন আগে আমি সেখানে একটি চাকরী পাই। চাকুরীর একপর্যায়ে ভিসা শেষ হয়ে যাওয়ায় আমি হংকং থেকে চায়না চলে যাই। সেখান থেকে আবারও হংকং ফেরত এসে তিন মাসের ভিসা পাই। এরপর আমি যখন আর হংকং এর ভিসা পাবোনা তখন আমি থাইল্যান্ড, তাইওয়ান ও হংকং হয়ে ঢাকা চলে আসি। এবার ঢাকা থেকে আমি পর্তুগাল চলে যাই। সে সময় আমি পর্তুগালের পাশাপাশি কোরিয়ার ভিসাও পেয়ে যাই। এরপর পর্তুগালে চাকরী শুরু করলেও পরবর্তীতে ব্যবসা শুরু করি।’
সময়: শুরুর দিকে আপনি কিভাবে বাংলাদেশীদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য কাজ শুরু করলেন?
রানা তাসলিম উদ্দিন: সময়টা ১৯৯৩ সালের কথা, ১৮৫ জন বাংলাদেশীর কাগজপত্র ঠিক করার জন্য আমি রাতদিন কাজ করি। তখন আমি প্রায় ৩০০ কিঃমিঃ দূরে অবস্থিত কনস্যুলার অফিসে নিয়মিত যাতায়াত করে তাদের পাসপোর্ট আনি। এরপর বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তোলার মাধ্যমে জনসাধরণের সাথে মিশতে থাকি। যা পরবর্তীতে আমার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করে।
সময়: বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশীরা ঠিক কি ধরনের প্রতিবন্ধকতার শিকার হয় বলে আপিন মনে করেন?
রানা তাসলিম উদ্দিন: প্রথমত, ভাষা না জানার প্রতিবন্ধকতা। এরপর সঠিক কাগজপত্র না থাকা। যেমন লিগ্যাল কোন কাগজপত্র না থাকলে যে কেউ সমস্যায় পড়ে যাবেন। তাই যত দ্রæত সম্ভব লিগ্যাল কাগজপত্র বানিয়ে ফেলে নিজের অবস্থানকে পোক্ত করে ফেলতে হবে। এর পাশাপাশি বাঙ্গালী কমিউনিটি না থকলেতো বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার শিকারও হতে পারেন।
সময়: পর্তুগীজ ও বাংলাদেশীদের মধ্যে কি কি ব্যবসা রয়েছে?
রানা তাসলিম উদ্দিন: মুক্তবাজার অর্থনীতির কারনে সারা পৃথিবী এখন উন্মুক্ত। পর্তুগাল ও বাংলাদেশের মধ্যে অনেক ব্যবসা রয়েছে। কেউ যদি চায় যে পর্তুগালে ব্যবসা করবে তাহলে তা সম্ভব। আবার পর্তুগীজরাও কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে ব্যবসা করছে। পর্তুগাল থেকে অলিভ অয়েল, কক বাংলাদেশে আমদানী হয় আবার বাংলাদেশ থেকে পর্তুগালে গার্মেন্টস সামগ্রী, চিংড়ী মাছ রপ্তানী হচ্ছে। তাছাড়া পর্তুগীজ ও বাংলাদেশের মধ্যে বিভিন্ন যৌথ ব্যবসা রয়েছে; এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- জুতার ফ্যাক্টরি। বিটিআরসি’তে টেলিকমিউনিকেশনের জন্য যে প্রযুক্তি ব্যবহার হয় তা বাংলাদেশে পর্তুগাল রপ্তানী করে। এছাড়াও প্রতিবছর হজ্জ মৌসুমে যাত্রী আনা নেওয়ার জন্য পর্তুগীজ থেকে বিমান ভাড়া করে বাংলাদেশ সরকার।
রানা তাসলিম পর্তুগালের সামাজিক, সাংস্কৃতিকর্মী রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অনেক সংগঠনের সাথে প্রথম থেকেই জড়িত হয়ে পড়েন। ১৯৯২ সালের ১৬ জুন মাত্র ১২ জন বাংলাদেশী নিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘বাংলাদেশ কমিউনিটি অব পর্তুগাল অ্যাসোসিয়েশন’। তিনি ছিলেন এ সংগঠনটির প্রধান সমন্বয়কারী ও প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারি। এরপর ১৯৯৪ সালে পর্তুগালের জাতীয়তা গ্রহণ করেন। ১৯৯৯ সালে বাংলা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর ২০০০ সালের ২১ ফেব্রæয়ারি তিনি প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ কালচারাল ইউনিয়ন অব পর্তুগাল।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত তিনি এ সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ২০০০ সালে বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভ‚মিকা পালন করে আহবায়কের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ২০০৭ সাল থেকে আজ অব্দি তিনি বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টারের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। তিনি পর্তুগালের মূল ধারার রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হন ২০০৫ সালে। ২০০৯ সাল থেকে তিনি সক্রিয় রাজনীতির সাথে যুক্ত হন। সর্বশেষ ২০১৩ সালে তিনি পর্তুগাল স্যোসালিস্ট পার্টি থেকে নির্বাচনের জন্য নমিনেশন পান। এরপর একই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি পর্তুগালের সান্তা মারিয়া মাইওর লিসবন থেকে কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। এর বাইরে তিনি একজন সফল ব্যবসায়ীও। ব্যক্তিগত জীবনে রানা তাসলিম স্ত্রী ও দুই সন্তানের জনক।
সময়: আপনিতো পর্তুগালে একটি এলাকার কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছিলেন। কাউন্সিলর হিসেবে আপনার দায়িত্ব কি ছিলো?
রানা তাসলিম উদ্দিন: আমি ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পর্তুগালের সান্তা মারিয়া মাইওর লিসবন থেকে কাউন্সিলর নির্বাচিত হই। দলের নমিনেশন নিয়ে সেখানে আমি নির্বাচন করি। আমি পর্তুগালের প্রথম বাংলাদেশী ও প্রথম এশিয়া মহাদেশীয় নির্বাচিত কাউন্সিলর। কাউন্সিলর হিসেবে আমার দায়িত্ব ছিলো, এলাকার জনসাধারনের সুবিধা-অসুবিধা পর্যবেক্ষণ করা। এলাকার উন্নয়নের বিভিন্ন উপায় বের করা। মজার বিষয় হচ্ছে, সেখানে আমাদের সাথে জনসাধারনের সরাসরি কোন যোগাযোগ নেই। সেখানের সব কিছুই একটি নিয়মের মধ্যে চলে। চাইলেই কিছু করে ফেলা সম্ভব নয়। কারন, প্রতিমাসে মেয়রের সাথে আমাদের মিটিং হয়। সেখানে এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয়। বোর্ড যদি মনে করে এই বিষয়টি এলাকার উন্নয়নে প্রয়োজন তাহলেই শুধু তার অনুমোদন দেয়।
সময়: আপনি পর্তুগালে থেকে সেখানের রাজনীতি করছেন। ওদের ও আমাদের রাজনীতির পার্থক্য কেমন বলে আপনি মনে করেন?
রানা তাসলিম উদ্দিন: দেখুন, অন্যদেশ আর আমাদের দেশে রাজনীতির মূল পার্থক্যটি হচ্ছে বিদেশীরা রাজনীতি করে দেশের স্বার্থে, জনগানের স্বার্থে। কিন্তু আমরা রাজনীতি করি নিজেদের স্বার্থে; যদিও মুখে বলি অন্য কথা। অন্য দেশে গণমাধ্যম স্বাধীন, তারা একটি স্বচ্ছ নীতিমালার আলোকে চলেন। কিন্তু আমাদের দেশে সব হয় নিজেদের স্বার্থে। অন্য দেশের গণমাধ্যম সঠিক তথ্যটি তুলে ধরতে সাহস পায়। কিন্তু বাংলাদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। এই অবস্থা থেকে যদি আমরা বের হতে না পারি তাহলে আগামী ১০০ বছর পরেও আমরা এই অবস্থায়ই পড়ে থাকবো। রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তণের পাশাপাশি এই ধরনের অসুস্থ মানসিকতা থেকে আমাদেরকে বেরিয়ে আসতে হবে। তবে আমি তরুনদের নিয়ে বেশ আশাবাদী। কারন, তথ্যপ্রযুক্তি ও বর্হিঃবিশ্ব যোগাযোগে তরুনরা এখন অনেক সচেতন। বাংলাদেশে রাজনীতি করে মোট জনগোষ্ঠীর ১০-১১%। এই ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী কোনক্রমেই সবাইকে পিছিয়ে রাখতে পারেনা। তাই আমার বিশ্বাস তরুনরা চেষ্টা অব্যহত রাখলে একসময় বাংলাদেশ বিশ্বের মাঝে উন্নত একটি দেশে পরিণত হবে।
সময়: পর্তুগালে বাংলাদেশের কেউ যেতে চাইলে তার করণীয় কি?
রানা তাসলিম উদ্দিন: আগেই বলেছি, পর্তুগালের সঙ্গে বাংলাদেশের অনেক ব্যবসা রয়েছে। তাই সেখানে ব্যবসার সুযোগ অবারিত। সেখানে যদি কেউ ব্যবসার জন্য যেতে চায় তাহলে তাঁকে পাঁচলক্ষ ইউরো (৫ কোটি টাকা) বিনিয়োগ করলে পর্তুগালে পরিবার সহ বসবাসের জন্য ‘গোল্ডেন ভিসা’ পাবেন তিনি। এরপর ৬ বছর পর নাগরীকত্ব পাওয়ার জন্য আবেদন করতে পারবেন। আর স্টুডেন্ট ভিসায় যেতে চাইলে তাঁকে সেখানে দুই বছর পর্তুগীজ ভাষা শিখতে হবে।
ব্যবসা, কাউন্সিলর ও বিভিন্ন সংগঠনের সাথে যুক্ত থাকার পাশাপাশি তিনি পর্তুগালের কোর্ট, ট্রাইব্যুনাল, পুলিশ, গোয়েন্দা বিভাগ, সিমান্তরক্ষী বাহিনীতে দোভাষী হিসেবেও কর্মরত রয়েছেন। তিনি ১৯৯৫ সাল থেকে এ শাখায় সরকারী তালিকাভুক্ত একজন কর্মকর্তা।
রানা তাসলিম উদ্দিন শুধু পর্তুগালের কর্মকান্ডের সাথেই যুক্ত নন। তিনি ২০১২ সাল থেকে আন্তর্জাতিকভাবেও কাজ করে আসছেন। তিনি অল ইউরোপিয়ান বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন (আয়েবা) এর প্রতিষ্ঠাতা ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে আজ অব্দি দায়িত্ব পালন করে আসছেন।
এই বিষয়ে তিনি জানান, ‘আমরা ইউরোপে বসবাসকারী বাংলাদেশীদের সুবিধা ও স্বার্থসংশ্লীষ্ট বিষয়ে আন্তর্জাতিকভাবে কাজ করছি। এই সংগঠনটি জাতিসংঘের ইউনেস্কো ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের তালিকাভুক্ত।