সাঈদ চৌধুরী
মূল্যবোধ সম্পন্ন লেখক কবি আলিফ উদ্দিন চলে গেছেন মহান মাবুদের দরবারে। জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে অনেক দিন থেকে ইংল্যান্ডের হাল শহরের রয়্যাল হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অধীনে ছিলেন। শনিবার (১৭ মে ২০২৫) ভোরে তিনি ইন্তেকাল করেছেন। ইন্না-লিল্লা-হি ওয়া ইন্না-ইলাইহি রা-জিউ’ন।
গত বছর (১০ জুন ২০২৪) কবি আলিফ উদ্দিনের সাহিত্য নিয়ে হাল শহরের বেভলিরোড ব্যালকন ক্যাফেতে আলোচনা ও লেখকের রোগমুক্তি কামনায় বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সেখানে কবির সৃজনকর্ম সম্পর্কে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছিলাম। অতিথি আলোচক ছিলেন লেখক ও সংগঠক সিরাজুল উসলাম শাহীন। উপস্থিত ছিলেন হাল মুসলিম সোসাইটির সভাপতি মুক্তাদির আলী, সেক্রেটারী মাহমুদ হোসাইন, সমাজসেবী মুশফিক শাহজাহান চৌধুরী, সাংবাদিক ইলিয়াস আকরাম, কমিউনিটি সংগঠক মোঃ জিলাদ, মাওলানা মাজহারুল হক, সমর আলী, এনামুল হক, রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ, মাহমুদ হোসাইন প্রমুখ। মোনাজাত পরিচালনা করেন হাল মুসলিম সোসাইটির বায়তুল মাল সম্পাদক মোঃ আব্দুল মালিক।
কবি আলিফ উদ্দিন আমার অত্যন্ত আপনজন ছিলেন। ১৯৮৯ সাল থেকে আমরা ঘনিষ্ঠ ছিলাম। কিছুদিন আগে কবির নতুন গ্রন্থ ‘কুরআনের ছবি’ ডাকযোগে উপহার পেয়ে একটা লেখা দিয়েছি।
‘কুরআনের ছবি’ বাংলা একাডেমির বই মেলা উপলক্ষে ঢাকার অরুণালোক প্রকাশনী থেকে বেরিয়েছে। লেখক কুরআন ও হাদিসের আলোকে শতাধিক বিষয়ে বর্ণনা করেছেন। জীবন জ্ঞিাসার অনেক জবাব বইটিতে তুলে ধরা হয়েছে। সুন্দর হার্ডব্যাক বাঁধাই করা ১৮০ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থের দাম চারশ টাকা মাত্র। প্রবাসে ১০পাউণ্ড ।
কবি আলিফ উদ্দিন সিলেটে এবং বিলেতের অত্যন্ত প্রিয় মুখ। তিনি সংলাপ সাহিত্য-সংস্কৃতি ফ্রন্টের নির্বাহী সদস্য। কবিতার পাশাপাশি প্রবন্ধ-নিবন্ধে মনের কথা সহজ ভাষায় তুলে ধরেন। লেখকের ভাবনা ও জ্ঞিাসার পরিধি বিচিত্র ও ব্যাপক। সমসাময়িক বিষয়, প্রজন্মের আশা-আকাঙ্ক্ষা, এমনকি হতাশাও মূর্ত হয়ে উঠেছে বইটিতে। ‘কুরআনের ছবি’ পরকালের শান্তির অন্বেষায় তিনি লিখেছেন। গ্রন্থটি ছুঁয়েছে পাঠক হৃদয়।
লেখক আলিফ উদ্দিনের প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে রয়েছ- চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দিন গুলো (প্রবন্ধ, ১৯৯০), মনের মনিকোটায় মক্কা (ভ্রমণ কাহিনী, ১৯৯০), একটি বিপ্লব চাই (উপন্যাস, ১৯৯৬), বৃটিশ সিটিজেন (উপন্যাস, ১৯৯৬), প্রথম ভালোবাসার প্রথম উপহার (গল্প, ২০০০), হুদয় ছুয়েছে ডায়েরী (কবিতা, ২০০৮), মরমী কবি আরফুল উল্লাহর জীবন ও কর্ম (জীবনী, ২০০৮), বিশ্বনবী মুহাম্মদ স. (জীবনী, ২০১১), সোনার পালংক (উপন্যাস, ২০১১), কুরআনের ছায়াতলে (রচনা সমগ্র, ২০১৪), জীবনযুদ্ধের স্মৃতি (আত্মজীবনী, ২০১৫), ছায়াবৃক্ষ (কবিতা, ২০১৯), নজরুল কাব্যে ইসলাম (প্রবন্ধ, ২০১৯), লন্ডন বাংলার চিঠি (পত্রালাপ, ২০১৯), কুরআনের ছবি (ধর্মীয় বিশ্লেষণ, ২০২১), এক আল্লাহ জিন্দাবাদ (কবিতা, ২০২৩) ।
কবি আলিফ উদ্দিনের লেখায় পুরোনো ও নতুনের মেলবন্ধনে অতীতকে মাথায় রেখেই ভবিষ্যৎ সাজানোর ঐতিহ্য চিন্তা পরিষ্কার ভাবে পাওয়া যায়। মানুষের কল্যাণ-অকল্যাণের পেছনে ধর্মীয় ব্যাখ্যাসমূহ তুলে ধরেছেন। কেন ধর্মীয় চেতনা মানব জীবনে প্রয়োজন? সেটা বর্ণনা করার চেষ্টা করেছেন। সমৃদ্ধ সংস্কৃতির পরতে পরতে নিয়ে যাওয়া তার অনুসন্ধান পাঠককে হয়ত রোমাঞ্চের মুখোমুখি করবে। ছোট ছোট বিষয় ভিত্তিক আলোচনায় আধুনিক বিজ্ঞানের পাশাপাশি চিরাচরিত মৌলিক প্রশ্ন আলোচিত হয়েছে। কোন বৈশিষ্ট্যের জন্য আমরা মানুষ, আর কিভাবে মানুষের স্রষ্টাকে বুঝতে সক্ষম হব- এসব জিজ্ঞাসার কিছুটা হদিস দিতে চেষ্টা করেছেন তিনি।
আলিফ উদ্দিন বিলাতে অনেক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলেন। কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ সিলেটে আজীবন সদস্য এবং রেনেসাঁ সাহিত্য মজলিস ইউকের সাবেক ট্রেজারার ও সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন।
ভ্রমণপ্রিয় আলিফ উদ্দিন সৌদি আরব, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইতালি, গ্রীস, ফ্রান্স-সহ বহু দেশ ও শহর সফর করেছেন। ২০০০ সালে কোলকাতায় একটি সাহিত্য সম্মেলনে তিনি অতিথি হিসেবে যোগদান করেন।
সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে অবদানের জন্য কবি আলিফ উদ্দিন বিভিন্ন সময় স্বীকৃতি ও সম্মাননা লাভ করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে দারুল কুরআন একাডেমী সম্মাননা-২০০১, ইনাতগন্জ একাডেমী সম্মাননা ২০০৭, রেনেসাঁ সাহিত্য পুরস্কার ২০০৮ এবং আল কুরআন একামী লন্ডন কর্তৃক লেখক স্বীকৃতি ২০১৪।
কবি আলিফ উদ্দিন সিলেট বিভাগের হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ থানাধীন কসবা গ্রামে ১৯৬৫ সালের ১৫ জানুয়ারি জন্ম গ্রহণ করেন। বর্তমানে যুক্তরাজ্যের হাল শহরে বসবাস করছেন। পিতা হাজি উয়াছিক উল্লাহ ও মাতা লুচন বিবি। পারিবারিক জীবনে তিন ছেলে ও দুই মেয়ের জনক।
বহুদিন ধরে কাছে থেকে দেখা কবি আলিফ উদ্দিনের সমাজসেবা ও লেখালেখি সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করে সিরাজুল ইসলাম শাহীন বলেন, লেখক আলিফ উদ্দিন আজীবন আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দ্বীন কায়েমের আন্দোলনে নিবেদিতপ্রাণ এক অনন্য মুজাহিদ। ১৯৮০-৯০ দশকে সিলেটের রাজপথের উত্তাল দিনগুলিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। যুক্তরাজ্যে এসেও দাওয়াতী কাজে নিজেকে সক্রিয় রেখেছেন।
হৃদয়ের গভীর থেকে সমবেদনা জানাই পরিবার ও শুভাকাঙ্খীদের। আমাদের প্রিয় ভাইটির রুহের মাগফিরাতের জন্য মহান আল্লাহর বিশেষ মেহেরবানী কামনা করছি। সকল পাঠকের কাছেও দোওয়ার আবেদন জানাই।
* সাঈদ চৌধুরী কবি ও কথাসাহিত্যিক, সম্পাদক: দৈনিক সময় ও মানব টিভি