বাড়তি সময় দেয়া হলেও দুর্নীতি দমন কমিশনের তলবে হাজির হননি সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ। অবৈধভাবে সম্পদ অর্জন করার অভিযোগে সাবেক এই পুলিশ প্রধান ও তার পরিবারের সদস্যদের রোববার সশরীরে দুদকে হাজির হওয়ার জন্য সময় দিয়েছিল দুদক।
প্রথম দফায় দুদকে হাজির হওয়ার সময়সীমার শেষদিনে মি. আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যরা আইনজীবীর মাধ্যমে সময় চেয়ে আবেদন করলে ১৫দিন বাড়তি সময় দিয়েছিল বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন।
দুদক আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বিবিসি বাংলাকে বলেন, “সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ একবার সময় পেয়েছেন, নতুন করে তাকে আর সময় দেয়া হবে না।” তিনি বলেন, “মি. আহমেদের জন্য আজীবন বসে থাকবে না দুর্নীতি দমন কমিশন। তাই আইন অনুযায়ী পরবর্তী প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হবে।”
গত এপ্রিলে দুর্নীতির অভিযোগে হাইকোর্টের একটি রিটে তার পক্ষে বেনজীর আহমেদ তার আইনজীবী হিসেবে নিয়োগ করেছিলেন ব্যারিস্টার শাহ মঞ্জুরুল হককে। রোববার মি. হক বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আমি এখন আর তার আইনজীবী নেই। সুতরাং তিনি দুদকে হাজির হবেন কী, হবেন না সেটি বলতে পারবো না”।
একের পর এক সম্পত্তির তথ্য বেরিয়ে আসার পরও কেন মি. আহমেদের বিরুদ্ধে এখনো মামলা করছে না দুদক, সেটি নিয়েও নানা প্রশ্ন রয়েছে। দুর্নীতি বিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বিবিসি বাংলাকে বলেন, “দুদকের যদি সত্যিকার অর্থে ইচ্ছা থাকে, তাহলে তাদের কাছে এখন পর্যন্ত যে তথ্য আছে তার ভিত্তিতে মামলা করতে পারে। দুদকের এ বিষয়ে সদিচ্ছা থাকা জরুরি।”
এখন কী করবে দুদক?
সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ ও তাঁর স্ত্রী-সন্তানদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গত ২৮শে মে তলব করে দুদক। দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে পাঠানো নোটিশে বেনজীর আহমেদকে ৬ই জুন এবং তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদের ৯ই জুন দুদকে হাজির হয়ে বক্তব্য দিতে বলা হয়েছিল। তখন দুদকের কাছ থেকে বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যরা ১৫ দিন সময় নিয়েছিলেন। আইন অনুযায়ী দুদক তাদের পনেরো দিনের সময় দেয়।
দ্বিতীয় দফা হাজির হওয়ার দিন রোববার মি. আহমেদ ও তার পরিবার দুদকে উপস্থিত না হওয়ায় স্বাভাবিকভাবে পরবর্তী প্রক্রিয়া নিয়ে কী হবে সেটি নিয়ে অনেকের আগ্রহ রয়েছে। দুদক বলছে, সাবেক এই পুলিশ মহাপরিদর্শকের জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগের অনুসন্ধান চলছে। তার বিরুদ্ধে আরো অপরাধলব্ধ সম্পদের প্রমাণ মিলেছে।
রোববার সশরীরে হাজির না হওয়ায় নিয়ম অনুযায়ী তার ঠিকানায় সম্পদ বিবরণী দাখিলের নোটিশ পাঠানো হবে। এরপর ২১ কর্মদিবস এবং পরে সময়ের আবেদন করলে আরও ১৫ কর্মদিবস সময় পাবেন তিনি। দুদকের আইনজীবী মি. খান বিবিসি বাংলাকে বলেন, “উনি আসুক না আসুক আমাদের অনুসন্ধান চলতে থাকবে। অনুসন্ধান শেষে অনুসন্ধানকারী দল কমিশনে প্রতিবেদন দাখিল করবে। এরপর কমিশনের অনুমতিক্রমে পরবর্তী কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে”।
মি. আহমেদের বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান শুরুর পরই তিনি দেশের বাইরে চলে গেছেন বলে বাংলাদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে। দুদকে হাজির হতে ১৫ দিন সময় চাওয়ার পর প্রশ্ন উঠেছিল আদৌ কি দুদকে হাজির হতে দেশে ফিরবেন মি. আহমেদ?
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বিবিসি বাংলাকে বলেন, “বেনজীর আহমেদ যে দুদকের তলবে সাড়া দিয়ে আসবেন এটা প্রত্যাশা করাই অমূলক ছিল। হয়তো বাস্তবতা মেনেই দুদক তাকে সময় দিয়েছিল”।
বেনজীরের বিরুদ্ধে মামলা নিয়ে যে প্রশ্ন!
সাবেক এই পুলিশ প্রধানের সম্পত্তির নিয়ে প্রায় দুই মাস ধরে অনুসন্ধান চালাচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন। এখন পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয় বহির্ভূতভাবে বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জনের প্রমাণও পেয়েছে। এসব কারণে মি. আহমেদ ও তার পরিবারের সম্পত্তি জব্দ এবং ব্যাংক একাউন্ট জব্দেরও নির্দেশ দিয়েছে আদালত। দুদক বলছে, এখনো সাবেক এই পুলিশ প্রধানের সম্পদের অনুসন্ধান চালাচ্ছে তারা।
তার এই সম্পত্তি অর্জন ও সম্পত্তির হিসাব দাখিল করে দুদকের কাছে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ ছিল মি. আহমেদের। কিন্তু সময় চেয়ে আবেদন করার পরও রোববার দুদকে আসেননি বলেই দুদকের আইনজীবী নিশ্চিত করেছেন। এখন দুদকে হাজির না হওয়ার পরবর্তী প্রক্রিয়ার কথা বললেও মামলার বিষয়ে কিছু বলেননি দুদকের আইনজীবী।
দুদক আইন অনুযায়ী মি. আহমেদ সম্পদ বিবরণী দাখিল না করলে তার বিরুদ্ধে মামলা করার বিধান সুযোগ রয়েছে। দুদকে সম্পদ বিবরণী দাখিল না করার জন্য হতে পারে ‘নন-সাবমিশন’ মামলা, আর জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের’ মামলা করারও সুযোগ রয়েছে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বিবিসি বাংলাকে বলেন, “বেনজীর আহমেদ অবৈধভাবে যে সম্পদ অর্জন করেছেন সেটি দুদকের অনুসন্ধানে প্রমাণিত। যদি সত্যিকার অর্থে ইচ্ছা থাকে তাহলে এখন পর্যন্ত যে তথ্য আছে তার ভিত্তিতেই মামলা করতে পারে দুদক”।
দুদক আইনে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের মামলায় ১০ বছর এবং নন-সাবমিশন মামলায় তিন বছরের সাজার বিধান রয়েছে। কিন্তু মামলা করতে দুদকের কোন গাফিলতি রয়েছে কী না এমন প্রশ্ন করা হয়েছিল সংস্থাটির আইনজীবী খুরশীদ আলম খানের কাছে।
জবাবে মি. খান বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, “সাবেক আইজিপি বেনজীরের সম্পদের অনুসন্ধান কার্যক্রম চলতে থাকবে। অনুসন্ধান শেষে রিপোর্ট জমা দেয়া হবে। এই রিপোর্ট দেখে কমিশন পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে। মামলার অনুমোদনের বিষয় কমিশনের হাতে”।
সাবেক এই পুলিশ প্রধানের কত সম্পদ?
এক মাস আগে গত মে মাসের ২৪ তারিখ দুদকের আবেদনের প্রেক্ষিতে সাবেক পুলিশ প্রধান মি. আহমেদের সম্পত্তি ক্রোকের নির্দেশ দেয় আদালত। ওই দিন দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত বেনজীর আহমেদ, তাঁর স্ত্রী, দুই মেয়ে ও এক স্বজনের নামে থাকা ৩৪৫ বিঘা (১১৪ একর) জমি ক্রোক বা জব্দের আদেশ দেন।
মি. আহমেদ ও তাঁর স্ত্রী-সন্তানদের নামে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকে থাকা ২৩টি ব্যাংক হিসাব (অ্যাকাউন্ট), ক্রেডিট কার্ড চারটি ও ছয়টি বিও অ্যাকাউন্ট অবরুদ্ধের আদেশও দেন। দু দিন পর গত ২৬ মে একই আদালত বেনজীর আহমেদের স্ত্রী জীশান মীর্জার নামে থাকা মাদারীপুরে ২৭৬ বিঘা জমি এবং বেনজীর পরিবারের নামে থাকা গুলশানের চারটি ফ্ল্যাট জব্দের আদেশ দেন। একই দিন বেনজীর আহমেদ ও তাঁর স্ত্রী-সন্তানদের নামে থাকা ১৯টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও তিনটি বিও হিসাব এবং ৩০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র ফ্রিজ করার আদেশ দেওয়া হয়। সাভারের কিছু জমিও রয়েছে একই আদেশের মধ্যে।
তৃতীয় দফায় গত ১২ই জুন বেনজীর আহমেদ, তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদের নামে থাকা আরো আটটি ফ্ল্যাট এবং ২৫ একর (৬০.৫ কাঠা) ২৭ কাঠা জমি জব্দের (ক্রোক) আদেশ দিয়েছেন আদালত। একই সঙ্গে মি. আহমেদ ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা বেসরকারি সিটিজেন টেলিভিশন ও টাইগার ক্রাফট অ্যাপারেলস লিমিটেডের শেয়ার অবরুদ্ধ করারও আদেশ দিয়েছেন আদালত।
কোথায় আছেন বেনজীর আহমেদ?
বেনজীর আহমেদের দেশ ছেড়েছেন নাকি দেশেই আছেন সেটি নিয়ে নানা কানাঘুষা আছে। কিন্তু এ নিয়ে স্পষ্ট কোনো তথ্য কেউ বলছেন না। বাংলাদেশের গণমাধ্যমে যে সব খবর প্রকাশিত হচ্ছে তাদের মধ্যে অনেকেই দাবি করেছে, গত চৌঠা মে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে দেশ ছাড়েন সাবেক এই পুলিশ কর্তা। একই সাথে দেশ ছেড়েছেন তার তিন মেয়ে ও স্ত্রী।
কোনো কোনো গণমাধ্যমের খবর বলছে, বেনজীর আহমেদ সিঙ্গাপুর আছেন। কোনো কোনো গণমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে, বর্তমান অবস্থান দুবাইয়ে। সর্বশেষ মঙ্গলবার একটি গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে তুরস্কে নিজের কেনা বাড়িতে আছেন সাবেক এই পুলিশ মহাপরিদর্শক।
এত সব খবরের ভিড়ে এখনো পর্যন্ত ধোঁয়াশা রয়েই গেছে তার অবস্থান নিয়ে। গণমাধ্যমগুলোর কোনো কোনোটি আবার বলছে, দেশেই আছেন বেনজীর আহমেদ। এমন অবস্থায় গত পাঁচই জুন একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান জানিয়েছিলেন, বেনজীর আহমেদের সিঙ্গাপুরে যাওয়ার কথা তিনি নিজেও শুনেছেন। তবে সেটি নিশ্চিত করে বলতে পারেন না তিনি।
এসময় তিনি বলেছিলেন, “আমার আশা তিনি হয়তো ফিরে আসবেন। যে সমস্ত অপবাদ তার নামে আসছে, তিনি নিশ্চয়ই দেশে এসে সেগুলো ফেস করবেন।” বিবিসি বাংলার পক্ষ থেকে চেষ্টা করা হলেও বেনজীর আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তার আইনজীবী শাহ মঞ্জুরুল হক জানিয়েছেন, এখন তিনি তার মামলার দায়িত্বে নেই, ফলে তার খোঁজ তিনি জানেন না। – বিবিসি বাংলা